মাওলানা শফিকুল হক আকুনী রহ. এর জীবন ও কর্ম
April 28 2019, 09:54
দীর্ঘদিন ইলমে দ্বীনের খেদমতের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অসামান্য সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন মাওলানা শফিকুল হক আকুনী। বহু শিক্ষার্থীর জীবনকে ইলমে দ্বীনের আলোয় আলোকিত করে সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় এ আলেমে দ্বীন অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে গেছেন। জীবনের সিংহভাগ সময় ইলমে দ্বীনের খেদমতে কাটিয়ে দেয়ার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এ খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ দীর্ঘকাল ধরে ইলমে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। সর্বোপরি ইলমে দ্বীনের খেদমতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলই তার অভীষ্ট লক্ষ্য। একজন আজীবন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদ ও মুহাদ্দিস হিসেবে অর্জন করেছেন স্বকীয় খ্যাতি। নম্র-ভদ্র ও চারিত্রিক মাধুর্যের অধিকারী এ আলেমে দ্বীনের মেহমানদারীতায় মুগ্ধ হতে হয়।
মাওলানা শফীকুল হক আকুনী ১৯০১ সালে সিলেট জেলার কানাইঘাট থানাধীন নিজধলই কান্দি (আকুনী) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মাওলানা ইব্রাহিম আলী দেওবন্দী আজীবন দ্বীনের খেদমতে ছিলেন নিয়োজিত। তিনি ঐতিহ্যবাহী জামেউল উলুম গাছবাড়ী মাদ্রাসার সনামধন্য প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত উক্ত মাদ্রাসা সিলেট তথা সমস্ত বাংলাদেশে ইসলামী জ্ঞান প্রচার ও প্রসারে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে আসছে। অসংখ্য আলেমে দ্বীন ও ইসলামী সমাজ গড়ার কারিগর এ মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে ইসলামী আন্দোলনে রেখে আসছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। তাঁর দাদা একজন দ্বীনের পাবন্দ, পরহেজগার ও সমাজ সচেতন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি পবিত্র হজ্জব্রত পালন অবস্থায় পবিত্র মক্কায় ইন্তেকাল করেন এবং তাকে জান্নাতুল মুআল্লায় দাফন করা হয়। মাওলানা শফিকুল হক আকুনীর পূর্ব পুরুষ ছিলেন প্রখ্যাত পুরুষ এমাদ উদ্দীন জঙ্গী। এমাদ উদ্দীন জঙ্গীর পুত্র বাদশাহ নূর উদ্দীন জঙ্গী ইতিহাস খ্যাত একজন ন্যায় বিচারক ও দূরদর্শী শাসক ছিলেন। তাঁর মাতা মরহুমা আমিনা বিবি একজন পর্দানশীন, দ্বীনদার ও গুণবতী মহিলা ছিলেন। তাঁর পিতা-মাতার ই”ছা ছিল একমাত্র পুত্র সন্তান হিসেবে তাকে আলেমে দ্বীন বানাবেন। শিশু অবস্থায় তাঁর পিতা-মাতা ইন্তেকাল করেন। তবে তাঁর চাচা হাজী মুবারক আলী সাহেবের তত্ত্বাবধানে থেকে তিনি সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান হিসেবে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হয়ে পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাকে সমুন্নত করেন। উল্লেখ্য তাঁর জন্মস্থান ও আশপাশ এলাকা ইসলামী শিক্ষা, তাহযীব-তামাদ্দুনের কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে বিবেচিত। ছাত্র জীবনের প্রারম্ভে তিনি গ্রামের মক্তবে প্রাথমিক আরবী শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর ঐতিহ্যবাহী জামেউল উলূম গাছবাড়ী মাদ্রাসায় মক্তব চাহরম পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তিনি জৈন্তাপুর থানাধীন খরিলহাট মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে নাহুমীর জামাত পর্যন্ত অধ্যয়ন করে পুনরায় গাছবাড়ী জামেউল উলূম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। উক্ত মাদ্রাসায় প্রতিটি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান দখল করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এ মাদ্রাসা থেকে ১৩৪২ হিজরী সনে তাকমিল ফিল হাদীস (কামিল) পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১মস্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন। এরপর উক্ত মাদ্রাসায়ই ২ বছর অধ্যাপনা করেন। এরপর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন এবং ১৩৪৫ হিজরী সনে আবার দাওরায়ে হাদীস পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে রয়েছেন-কুতবুল আলম শায়খুল ইসলাম সাইয়্যেদ হোসাইন আহমদ মাদানী র., আল্লামা ইদ্রীছ কান্দলভী র., আল্লামা আব্দুল হক হক্কানী র., আল্লামা আব্দুছ ছামাদ বাণীগ্রামী র., ফখরুল উলামা মুশাহিদ বায়মপুরী র., আল্লামা আহমদুল হক করিমগঞ্জী র., আল্লামা শফিকুল হক র. প্রমুখ।
কর্মজীবনে দেওবন্দ থেকে ফিরে এসে গাছবাড়ী জামেউল উলূম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মহৎ পেশায় যোগদান করেন। উক্ত মাদ্রাসায় তিনি যাবতীয় কঠিন কিতাবাদির সুদীর্ঘ ১২ বছর যাবত অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেন। এরপর আল্লামা বায়মপুরী র., এর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী কানাইঘাট দারুল উলূম মাদ্রাসায় তিনি অতি দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার সাথে দীর্ঘ ১২বছর ইলমে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। এরপর শায়খুল হাদীস হিসেবে খরিলহাট মাদ্রাসায় ৮ বছর, দারুল উলূম মৌলভী বাজার মাদ্রাসায় ১বছর ও সুনামগঞ্জের দরগাপুর মাদ্রাসায় ১বছর হাদীসের দরস দেন। ১৩৬০ বাংলায় তিনি নিজ এলাকায় গাছবাড়ী মুজাহিরুল উলূম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সাথে যারা এর প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা হলেন মাওলানা শহর উল্লাহ র., মাওলানা হাবিবুর রহমান নয়াগ্রামী, আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী র., হাজী ইরফান আলী আকুনী, হাজী আরজু মিয়া আকুনী, ওয়াজিদ মিয়া ফখরচটি, হাজী আব্দুল্লাহ ধলিবিল দক্ষিণ, হাজী মুখলিছুর রহমান ধলিবিল দক্ষিণ, হাজী হাফিজ শওকত দলইকান্দি, মাওলানা হায়াত উল্লাহ আগতালুক উত্তর। উক্ত টাইটেল মাদ্রাসা থেকে হাজার হাজার আলেমে দ্বীন তৈরী হয়ে দ্বীনের খেদমতে রত আছেন।
তিনি আযাদী তথা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা । তাঁর কৃতি ছাত্ররা হলেন-হাফিজ মাওলানা জওয়াদ-প্রতিষ্ঠাতা শায়খুল হাদীস রাজাগঞ্জ মাদ্রাসা, মাওলানা ওয়ারীছ উদ্দীন হাজীপুরী-শায়খুল হাদীস বুধবারী বাজার মাদ্রাসা, মাওলানা ফয়জুল বারী-মুহতামিম কানাইঘাট দারুল হাদীস মাদ্রাসা, মাওলানা আলীম উদ্দীন দুর্লভপুরী-শায়খুল হাদীস কানাইঘাট মাদ্রাসা, মাওলানা মুহাম্মদ লক্ষীপুরী-শায়খুল হাদীস কানাইঘাট মাদ্রাসা, মাওলানা আব্দুল লতিফ -শায়খুল হাদীস কানাইঘাট মাদ্রাসা, মাওলানা রুহুল আমীন-মুহতামিম গাছবাড়ী মুজাহিরুহুল উলুম মাদ্রাসা, মাওলানা মুহিব্বুল হক-শায়খুল হাদীস দরগাহ ক্বাসিমুল উলূম মাদ্রাসা, মাওলানা আব্দুল্লাহ হরিপুরী র., মাওলানা ইলিয়াছ- মুহতামিম দয়ামীর মাদ্রাসা, মাওলানা হুসাইন আহমদ-শায়খুল লাফনাউট মাদ্রাসা, মাওলানা মাহমুদুল হাসান-শায়খুল হাদীস ও মুহতামিম লাফনাউট মাদ্রাসা, মাওলানা আব্দুল করীম ছত্রপুরী-মুহাদ্দিস লাফনাউট মাদ্রাসা প্রমুখ।
তিনি ধলইকান্দি মিফতাহুল উলূম মক্তব মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, সিমাবাজার জামে মসজিদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আমরপুর মক্তব ও মহিলা মাদ্রাসা, উপদেষ্টা সিমাবাজার শাইখুল ইসলাম একাডেমী, পূর্ব সিলেট কৌমি মাদ্রসা বোর্ডের তিনি সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সিলেট জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘ ১০ বছর যাবত। ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদের তিনি উপদেষ্টা, তারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সিমা বাজার এবং পোষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এছাড়া জৈন্তা, কোম্পানিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, বিয়ানিবাজার সহ প্রায় সব ক’টি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদীস খোলার সময় তাকেঁ দিয়েই উদ্বোধন করা হত। মাওলানা শফিকুল হক আকুনীর রাজনৈতিক জীবনও বর্ণাঢ্য। জমিয়তের উদ্যোগে তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক অঙ্গনে সফর করেছেন। মুফতী মাহমুদ র.ও হাফীজুল হাদীস আল্লামা দরখাস্তী র.এর সাথে তাঁর রাজনৈতিক বৈঠক ও মতবিনিময় হয়েছে। বিভিন্ন কর্মকান্ডে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মিলে। তৎকালীন গোলপগঞ্জ স্কুল মাঠে পূর্ব-পাক ‘কুল পাকিস্তান’ কনফারেন্স অনুুষ্ঠিত হলে তিনি খুতবায়ে ইস্তেকবাল পাঠ করেন। সে সময় পাকিস্তানের ৯ জন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও নেতৃস্থানীয় বুজুর্গদের সামনে বিশেষ প্রশংসা লাভে ধন্য হন। পাঠের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন গোলাম গৌছ হাজারভী। তিনি ইস্তেকবালের তাৎপর্য বর্ণনা করেন প্রায় দেড়ঘন্টা যাবত। উক্ত বর্ণনায় সরকারের ফ্যাসিবাদি চরিত্রের মুখোশ উম্মোচিত হয়। এ থেকে বুঝা যায় তাঁর ইস্তেকবালের সারাংশ কতো গভীরতর ছিলো।
তিনি ১১ বার পবিত্র হজ্ব সম্পাদন করেন। তাছাড়া পাকিস্তান, ভারত, আরব-আমিরাত সফর করে বিস্তর অভিজ্ঞতা হাসিল করেন। তিনি কুতবুল আলম মাদানী রহ.-এর বিশিষ্ট খলীফা হাফিজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রহ.-এর হাতে বাইআত গ্রহণ করেন। তাজকিয়ায়ে ক্বলবের মেহনতে সফলতার নিদর্শন স্বরূপ ১৯৮০ সালে স্বীয় পীরের কাছ থেকে এজাযত হাসিলে সক্ষম হন। তিনি আজীবন নিজ বিশ্বাসের প্রতি অটল ছিলেন। ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে একজন মশহুর বক্তা হিসেবে প্রচুর খ্যাতি লাভ করেন। পারিবারিক জীবনে তিনি গড়াই গ্রামের মুন্সি আব্দুল হালিম রহ. এর ২য়া কন্যা মারিয়া খাতুনের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৩ পুত্র ও ৬ কন্যা সন্তানের জনক। তারা হলেন- মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক- শায়খুল হাদীস বারিধারা মাদরাসা ঢাকা, মৌলভী ছয়ফুল্লাহ খালেদ- আরব ও দুবাই- এ ব্যবসায়রত, মাওলানা আব্দুল্লাহ মছরুর – সৌদী আরবে ব্যবসায় জড়িত, খদিজা খানম, রায়হানা খানম, ছলমা খানম, নাজমা খানম, হাসনা খানম, বুশরা খানম। তারা সকলই বিবাহিতা। বড় বড় আলেমদের সাথে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর জীবনী সংগ্রহ করার পর তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।