সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল মালিক রুপষপুরীর জীবন ও কর্ম

October 14 2019, 03:51

ভূমিকাঃ সিলেটের সনামধন্য শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল মালিক রুপষপুরী ( শমশেরনগরী) দা.বা.। সমসাময়িক অনেকের কাছে যিনি মুস্তাজাবুদ্দাওয়াত হিসেবে পরিচিত। উঁচু মানের আলেমে দীন ও অসংখ্য আলেমের উস্তাদ হওয়া সত্বেও সহজ সরল ও অনাড়ম্বর চালচলন তাঁকে সর্বজন শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন করে দিয়েছে। প্রচারবিমূখ এই মহান আলেমের সংক্ষিপ্ত পরিচয় কওমি পিডিয়ার পাঠকের সামনে পেশ করা হলো।

জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
শায়খুল হাদীস মাওলানা আবদুল মালিক রুপষপুরী, মৌলভীবাজার জেলার, কমলগঞ্জ উপজেলাধীন, প্রশিদ্ধ শহর শমসেরনগরের অদূরে রুপষপুর গ্রামে, একসম্ভ্রান্ত মুসলিম তালুকদার বংশে, ১৯৪৭ ইংরেজীর ৩১ ডিসেম্বর, রোজ শনিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি প্রথম। তাঁর পিতার নাম মরহুম জহুর আলী ও মাতার নাম মরহুমা আলিফজান বিবি।

 

শিক্ষা জীবন:

মকতব ও প্রাইমারী স্কুল দিয়ে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সূচনা হয়। চার বছর প্রাথমিক স্কুলে লেখাপড়া করে পরবর্তীতে খলীফায়ে মদনী, শায়খ মুহাম্মদ আলী বলরামপুরী রহ. কর্তৃক পরিচালিত বলরামপুর হুসানিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে প্রথমে “মুতাফাররিকাহ” জামাতে একবছর পড়ার পর ছাফেলা আউয়ালে ভর্তি হয়ে ছাফেলা চাহারম পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। তারপর চলে যান জামেয়া হুসাইনিয়া গহরপুরে। সেখানে কাফিয়া জামাত থেকে মুখতাসার জামাত পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে পড়ালেখা করেন।

অতপর একাত্তরের সংগ্রামের সময় চলে যান গুলাপগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ইসলামী বিদ্যাপীঠ ঢাকাদক্ষিণ মাদ্রাসায়। সেখানে ১৩৯৪ হিজরি মোতাবেক ১৯৭৩ ঈসায়ীতে মেধাতালিকাভুক্ত হয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। মাওলানা আবদুল মালিক সাহেব তাযকিয়ায়ে নফস তথা আধ্যাত্ত্বিক সাধনার লক্ষ্যে প্রথমে আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রহ.এর কাছে বায়াত হন।

শায়খে রেঙ্গা রহ.এর ওফাতের পর খলীফায়ে মদনী, আরিফ বিল্লাহ, হযরত শায়খ মুহাম্মদ আলী (শায়খে বলরামপুরী) রহ. এর কাছে বায়াত হন এবং তাঁর খেলাফত ও ইজাযত লাভ করেন। কর্মজীবনঃ মক্তবের শিক্ষকতা ও মসজিদের ইমামতি দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা করে পর্যায়ক্রমে তিনি মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্ছ শিক্ষকের আসনে সমাসীন হন। দারসে নেযামীর প্রায় সবগুলো কিতাবের তিনি পর্যায়ক্রমে অধ্যাপনা করেন। ছারফ,নাহু, বালাগাত, মানতিক, ফেকাহ, তাফসীর ও হাদীস এবং উলূমে হাদীসের প্রতিটি কিতাবের উপর তাঁর অগাধ দখল রয়েছে। যার অন্যতম কারণ হলো ; উক্ত বিষয়বিত্তিক কিতাবগুলোর উপর বিভিন্ন সময়ে তিনি বারবার দারস দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের বৃহদাংশ তিনি হাদীসের খেদমতে অতিক্রম করছেন।

প্রায় দুই যুগ ধরে বুখারী শরীফের দারস দানে নিয়োজিত থাকার কারণে তিনি এখন বৃহত্তর সিলেটের অন্যতম শায়খুল হাদীস হিসেবে সর্বস্তরের উলামায়ে কেরামের স্বীকৃতি লাভ করেন। বর্তমানে তিনি সিলেটের বহরগ্রাম মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস হিসেবে খেদমতে আছেন।

শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল মালিক সাহেব পর্যায়ক্রমে কুলাউড়ার ফজলবাগ মাদ্রাসায় দুই বছর, কর্মধা মাদরাসায় ছয় বছর, মৌলভীবাজারের বরুণা মাদ্রাসায় এক বছর, জামেয়া দীনিয়ায় কিছু কাল, অতপর সিলেটের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায় (দুইবারে) দীর্ঘ তেরো বৎসর শিক্ষকতা করেন। তারপর তাঁর উস্তাদ ও মুরশিদ আরিফবিল্লাহ হযরত শায়খে বলরামপুরীর নির্দেশে তাঁর এলাকায় চলে আসেন এবং জামেয়া হুসাইনিয়া বলরামপুর মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত হন।

তাঁর শায়খের আদেশে শিক্ষাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে অল্প দিনেই উক্ত মাদরাসাকে তিনি দাওরায়ে হাদীস পর্যায়ে উন্নীত করেন। হজরত আল্লামা গহরপুরী রহ. এর নির্দেশে পরবর্তীতে তিনি উক্ত মাদরাসার শায়খুল হাদীস নিযুক্ত হন। দীর্ঘ ঊনিশ বছর এখানে অতিক্রম করেন। মধ্যখানে বলরামপুর মাদরাসার পাশাপাশি মৌলভীবাজারের কালিয়ারগাঁও মাদ্রাসায়ও দুই বছর শায়খুল হাদীস ছিলেন। বর্তমানে জামেয়া ইসলামিয়া হাফিজিয়া বহরগ্রাম,গুলাপগঞ্জ, মাদ্রাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে হাদীসের খেদমতে নিবেদিত আছেন। তাঁর শিক্ষক জীবনের বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন মাদ্রাসার মুহাদ্দিস, শায়খুল হাদীস হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষাসচিব ও মুহতামিমের দায়িত্ব আদায় করেন।

উল্লেখযোগ্য অবদানঃ একজন সফল শিক্ষক হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি অসংখ্য আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, শায়খুল হাদীস, নাযিম, মুহতামিম ও দীনের দায়ী তৈরীতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর একান্ত ছাত্রদের অন্যতম কয়েকজন হলেন ; শায়খুল হাদীস আবদুর রহমান মনোহরপুরী ( লন্ডন), শায়খুল হাদীস আবদুল ওয়াদুদ রহ. ( লামাকাজী), শায়খুল হাদীস মুফতি তালেবুদ্দীন রহ. ( কাতিয়া), শায়খুল হাদীস মুঈনুদ্দীন সাহেব ( দেউলগ্রাম মাদরাসা), শায়খুল হাদীস হাবীবুর রহমান হবিগঞ্জী, শায়খুল হাদীস মুনির উদ্দিন ঢাকাদক্ষিণ, শায়খুল হাদীস ফখরুল ইসলাম মোগলাবাজারী, শায়খ মুহিউল ইসলাম বুরহান ( মুহতামিম জামেয়া রেঙ্গা), শায়খ নজরুল ইসলাম ( মুহতামিম কর্মধা মাদরাসা), শায়খ মুখলিছুর রহমান রাজাগঞ্জী প্রমুখ।

হযরত মাওলানা আবদুল মালিক সাহেব শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন মসজিদের খতীবের দায়িত্বও পালন করছেন, তাছাড়া ওয়াজ নসীহতের মাধ্যমে জনগণের কাছে দীন পৌঁছে দিতে সচেষ্ট রয়েছেন। তাঁর আন্তরিক ফিকির হলো মুসলমানদের ঘরে ঘরে হাফিজ, আলিম তৈরী করা। আর সেই ফিকিরের প্রথম রুপায়ন করেছেন তিনি তাঁর নিজপরিবারেই। তাঁর একান্ত মেহনতেই তাঁর সকল ভাই, তাঁর সন্তানগণ সহ ফ্যামেলির সবাই এখন সুযোগ্য আলেম, হাফিজ হিসেবে গড়ে উঠেছেন। মৌলভীবাজার জেলার উক্ত পরিবার এখন শতভাগ আলেম পরিবার হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেছে।

 

রাজনৈতিক তৎপরতা ঃ শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল মালিক সাহেব হক্কানী উলামায়ে কেরামের রাজনীতিতে সর্বদা সহমত থাকলেও রাজনৈতিক ময়দানে তিনি তেমন সক্রিয় হয়ে ওঠেননি। তবে চলতি দশকের শুরুর দিকে দেশের প্রবীন কিছু মান্যবর উলামায়ে কেরামের আহবানে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে তিনি সক্রিয় হন। প্রচার বিমুখ এই বুযুর্গ দলের কোনো পদ কিংবা দায়িত্ব গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশ করেন শুরু থেকেই।

কিন্তু জমিয়ত নেতৃবৃন্দের বারবার অনুরোধ ও দীনি সার্থের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করার কারণে এবং দেশের শীর্ষ বুযুর্গদের বিশেষ চাপে ২০১৬ সালে তিনি জেলা সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলার সভাপতি হিসেবে রাজনীতিতেও সক্রীয় ভূমিকা পালন করছেন। পারিবারিক জীবন ঃ পারিবারিক জীবনে তিনি চার ছেলে ও তিন মেয়ের জনক। ছেলেদের প্রত্যেকেই হাফিজে কুরআন এবং প্রথম তিনজন দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। সর্বকনিষ্ট ছেলে এখনও লেখাপড়া করছেন। আল্লাহ পাক এই মহান আলেমে দীনকে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করে জাতির কল্যাণের রাস্তা অব্যাহত রাখুক, পরিশেষে এটাই কামনা করছি। আমীন।

 

তথ্য প্রদান কারীঃ মাওলানা মুহিব্বুল আমীন মিনহাজ,

মুফতি আহমদ রফী জাকির।

Spread the love