শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ছাদিকুর রহমান শ্রীমঙ্গলী (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম
August 23 2020, 03:48
লিখেছেন> মুফতী তারেকুল ইসলাম
বহুবিধগুনাবলি, বৈশিষ্ট্য ও যোগ্যতার সমাবেশ ঘটেছিল মুনাজিরে যামান,শায়খুল হাদীস আল্লামা ছাদিকুর রহমান শ্রীমঙ্গলী রহ.-এর জীবনে। একাধারে তিনি ছিলেন হাদীস বিজ্ঞানের একজন পন্ডিত, উচ্চমার্গের শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক, একটি দাওরায়ে হাদীস মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম, দরদী ওয়াইয,সদা-হাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব।
তাছাড়াও ছিলেন একজন পরিশ্রমী সাধক আলেম, দুরদৃষ্টি সম্পন্ন,বিচক্ষণ ও হাজির জওয়াব(তাৎক্ষণিক প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম) একজন দক্ষ তার্কিক। তাঁর জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং নিয়মিত কাজ ছিল হাদীসের দরস দান। তিনি আজীবন সহীহ বুখারীর দারস দান করেছেন। আজীবন জুমআর খতীবও ছিলেন। কখনও দলাদলী ও ফিরকাবাজী করেননি, এটা তাঁর অপছন্দ ছিল। মুসলিম উম্মাহের ঐক্য তাঁর কাঙ্খিত বিষয় ছিল। মহান আল্লাহ তাঁর সকল সৎকর্ম কবুল করুন এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।
# জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার কালাপুর ইউনিয়নের লামুয়া এলাকায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ৩ রা শ্রাবণ ১৩৫১ বাংলা, মোতাবেক ২৭শে রজব ১৩৬৩ হিজরী, ১৮ ই জুলাই ১৯৪৪ ঈসায়ী, রোজ মঙ্গলবার জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আব্দুল মালিক ও মাতার নাম মরহুমা খোশবান বিবি। তাঁর দাদার নাম মুন্সী ইজহারুল্লাহ। তারা ছিলেন ধার্মিক ও খোদা ভীরু।
# শিক্ষা জীবনঃ
মাওলানা ছাদিকুর রহমান রহ.-এর শিক্ষা জীবন বেশ সমৃদ্ধ এবং কয়েকটি ধাপে বিভক্ত। সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরা হলোঃ
* ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে মুখস্থ শিক্ষার সুচনা হয় মা খোশবান বিবির কাছে।
* অতপর, কালাপুর গ্রামের মক্তবে ক্বারী ইরশাদ আলী সাহেবের নিকট ১৯৫১ ও ১৯৫২ সালে কায়েদায়ে বুগদাদী ও আম্মাপারা এবং কুরআন মাজীদ নাজারা পড়েন।
* ১৯৫৩ সালে কালাপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫৭ সালে প্রাইমারী শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতপর, মৌলভীবাজার জেলার বৃহত্তম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরুনা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে এক বছর লেখা পড়া করেন। তারপর কমলগঞ্জের সফাত আলী সিনিয়র মাদ্রাসায় এক বৎসর লেখাপড়া করেন।
অতপর, দেশের সর্ব বৃহৎ দ্বীনি শিক্ষাগার, উম্মুল মাদারিস খ্যাত চট্রগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় মুখতাছারুল মাআনীতে ভর্তি হন। ওখানে কিছু দিন লেখা পড়া করার পর আবহাওয়া তাঁর জন্য অনুকুল ছিল না বিধায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন উস্তাজগনের পরামর্শক্রমে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। জানুয়ারী ১৯৬৬ সালে ঢাকার জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগে পুনরায় “মুখতাছারুল মাআনী”জামাতে ভর্তি হয়ে সেখান থেকেই দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করে তাফসীরুল কুরআন বিষয়ে উচ্চতর তাখাসসুস পড়েন।
তাছাড়া এখানে থেকেই প্রতি রমজান মাসে, বাংলার বরেণ্য ক্বারী, উজানীর পীর হযরত মাওলানা ক্বারী ইব্রাহীম রহ.-এর নিকট হতে ইলমে ক্বিরাআতের সনদ লাভ করেন। তিনি লেখা-পড়ায় সর্বদা মনোযোগী, আন্তরিক ও পরিশ্রমি ছিলেন। ফলে মাদরাসার কিংবা বোর্ডের প্রত্যেকটি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। আবার কখনো প্রথম বিভাগে প্রথমস্থান অর্জন করেন। ঢাকার জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগে থাকাকালীন বহু সহপাঠীর সাথে প্রতিযোগিতা করে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর অন্যতম সহপাঠী ও প্রতিযোগি ছিলেন মুফতী ফজলুল হক আমিনী রহ., মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী রহ. এবং বেফাক বোর্ডের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাওলানা ইসমাঈল সাহেব প্রমুখ।
তিনি যেসব মণীষীদের সান্নিধ্য ও শিষ্যত্ব লাভ করেছেন,তাদের অন্যতম হলেন –
* মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.
* মাওলানা জাফর আহমদ উসমানী রহ.
* মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী রহ. * মাওলানা শায়খ লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ. * শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. * শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী হাটহাজারী( দা. বা.) সহ অনেক বিজ্ঞ ও জগৎখ্যাত উলামায়ে কেরাম।
# কর্ম জীবনঃ
শায়খুল হাদীস, মাওলানা ছাদিকুর রহমান শ্রীমঙ্গলী রহ.জ্ঞানার্জন ও দারস, তাদরীসেই নিজের জীবনের বৃহদাংশ অতিবাহিত করেন। তিনি একাধারে ৪৩ বছর শিক্ষকতা করেছেন।
লেখা-পড়া শেষ করে ১৯৯৭০ সালে যখন বাড়ীতে চলে আসেন, তখন বিশ্বনাথের প্রবীন আলেম হযরত মাওঃ আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রহ., যার জামেয়া কুরআনিয়া লালবাগ মাদ্রাসায় যাতায়াত ছিল খুব বেশী এবং সেখানকার শিক্ষকগনের সাথে ছিল খুব সুসম্পর্ক, সেই সুবাদে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়া বিশ্বনাথের জন্য একজন ভাল শিক্ষকের চাহিদা পেশ করলে তাঁরা মাওলানা ছাদিকুর রহমান শ্রীমঙ্গলীকে পেশ করলেন।
তাই ১৯৭০ সালে জামেয়া মাদানিয়া বিশ্বনাথের শিক্ষক হিসাবে তিনি নিয়োগ হলেন। দুই বৎসর যেতে না যেতেই ১৯৭২ সালে মাওলানা আশরাফ আলী শায়খে বিশ্বনাথী রহ. তাকে পদোন্নতি দিয়ে মাদ্রাসার নাযিমে তালিমাত (শিক্ষা সচিব) নিযুক্ত করেন। সেই থেকে ১৯৯০ ইংরেজি পর্যন্ত টানা বিশ বছর এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুহাদ্দিস হিসেবে অধ্যাপনা করেন। অতঃপর কোনো এক মত-পার্থক্যের কারণে জামেয়া মাদানিয়া বিশ্বনাথ থেকে চলে আসেন তিনি। এরপর তিনি বিশ্বনাথ সদরে ১২ই নভেম্বর ১৯৯০ ইংরেজী সালে প্রতিষ্ঠা করেন জামেয়া মুহাম্মদিয়া আরাবিয়া বিশ্বনাথ।
তিনি এ প্রতিষ্ঠানের আজীবন মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস ছিলেন। মৃত্যু অবধি টানা ২১ বৎসর এ গুরুদায়িত্ব সুনামের সাথে পালন করেন। এছাড়াও ১৯৯৭ ইং সালে নিজ গ্রাম, লামুয়া কালাপুরে প্রতিষ্ঠা করেন খেদমতুল কোরআন মাদ্রাসা। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি নিজেই এর সার্বিক পরিচালনা করতেন। তাঁর ইন্তেকালের পর মাদ্রাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাঁর একমাত্র সন্তান হযরত মাওঃ সাইদুর রহমান কাওছার সাহেব। বর্তমানে এই মাদ্রাসাটি নুরানি, হেফজ সহ মুতাঃ ৩বর্ষ (অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত চলছে। মাদ্রাসাটির উন্নতি ও তরক্কীর জন্য হুজুরের সাহেবজাদাহ নিরলসভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
এছাড়াও হযরত মাওলানা ছাদিকুর রহমান শ্রীমঙ্গলী রহ. সিলেটের জামেয়া দারুস সালাম, দারুল উলুম মৌলভীবাজার, জামেয়া দ্বীনিয়া মৌলভীবাজার সহ আরো কতিপয় প্রতিষ্ঠানে খন্ডকালীন শায়খুল হাদীস ছিলেন।
তিনি ১০ বার হজ্জের সফর করেন। তাছাড়া মুফাসসিরে কোরআন ও অতিথি বক্তা হিসাবেও বিভিন্ন দেশ সফর করেন। হযরতের পাঠদান পদ্ধতিঃ হযরত ছাত্রদের কোন দিনই প্রহার করতেন না। হযরতের পাঠদানের ধরন ছিল অসাধারণ, প্রথমে যে পাঠ তিনি পড়াবেন, সে পাঠের বিষয় বস্তু সর্ম্পকে আগে ছাএদের ধারণা দিয়ে দিতেন এবং সুন্দর বাচন-ভঙ্গিতে পাঠের বিষয় উদাহরণের মাধ্যমে ছাএদের সামনে তুলে ধরতেন, এরপর পাঠ্য পুস্তকে থাকা বিষয়-বস্তুুকে সামনে রেখে অর্থ (তরজমা) করতেন, তরজমা শেষে ছাএদেরকে বলতেন কি বুঝেছো; আমাকে একটু বলতো ? তখন অকপটে ছাএরা বলে ফেলত।
এটাই ছিল হুজুরের পঠন পদ্ধতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। তাযকিয়া বা আত্মশুদ্ধির মেহনতঃ ১৯৭০ সালে দাওরায়ে হাদীস পাশ করার পরই নিয়মানুযায়ী শায়খুল হাদীস ছাদিকুর রহমান সাহেব উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ হাকীমুল উম্মত আল্লামা শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ. এর অন্যতম খলীফা আমীরে শরিয়ত আল্লামা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফিজ্জী রহ. এর নিকট বাইয়াত হন। আজীবন তিনি তাঁর মুরশিদের সবক পালন করেছেন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে।তাই তাঁর জীবনে হাফিজ্জী হুজুর রহ. এর প্রভাব ছিল প্রবল।
তাসনিফাত বা লেখালেখিঃ একজন মৌলিক লেখক হিসাবে শায়খুল হাদীস আল্লামা ছাদিকুর রহমান শ্রীমঙ্গলীর রয়েছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে – ১. সেবাই কি পাদ্রীদের উদ্দেশ্য? ২.হক কথা ৩.মক্কা মদীনার ফয়সালা মানেনা কাহারা ৪.মুজাহিদে মিল্লাত. ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। # হযরতের মৃত্যুঃ বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী এই মহান ব্যক্তি দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার পর ০৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৪ ইংরেজী, রাত ২ ঘটিকার সময়,মৌলভী বাজারের লেইক ভিউ ক্লিনিকে দুআ ও যিকির রত অবস্থায় হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষকদের অভিভাবকহীন করে মহান প্রভুর আহব্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর সান্নিধ্যে চলে যান। ইন্না-লিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তিনি এক স্ত্রী, এক ছেলে ও চার মেয়ে, এবং নাতী-নাতনী সহ অসংখ্য ছাত্র ও ভক্ত মুরিদান রেখে যান। দুপুর ২ টায় হাজার হাজার উলামা, মাশায়েখ, ছাত্র জনতা ও সর্বস্তরের মুসলিম জনসাধারণের উপস্থিতিতে তাঁর জানাযা নিজ এলাকায়ই সম্পন্ন হয়।অতপর কালাপুরের লামুয়া এলাকায় তাঁর মা বাবার পাশে তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
আল্লাহ পাক তাঁকে জান্নাতের উচ্চাসনে সমাসীন করুন এবং আমাদেরকে নি’মাল বদল দান করুন, আমিন। তথ্য প্রদানকারীঃ মুফতী তারেকুল ইসলাম রুপষপুরী, শিক্ষক, খেদমতুল কোরআন মাদ্রাসা কালাপুর, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার