মাওলানা ফরিদ উদ্দীন চৌধুরী রঃ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
August 25 2020, 09:19
লিখেছেন- জাহিদ বিন নাসির :
আল্লাহপাক রাব্বুল আ-লামীন পৃথিবীতে এমনও অনেক মানুষ সৃষ্টি করেছেন যারা আপন যোগ্যতা ও বিচক্ষণতায় অনন্য। আপন নীতি ও বিশ্বাসের ওপর যারা সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দৃঢ় ও অবচিল। কুরআন ও সুন্নাহ নির্ভর যাদের পথচলা। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যারা সুন্নতের রঙ্গে রঙ্গীন। অসহায় গরীব দুঃখি মানুষের পরম বন্ধু,জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা সত্য ও ন্যায়ের পথে নিজের জীবন বিলীন করে দিতেন সেই মহারত্মদের একজন হলেন শ্রদ্ধেয় চাচাজান মরহুম মাওলানা ফরিদ উদ্দীন চৌধুরী রঃ ।
#জন্ম: হোসাইন আহমাদ মাদানী রঃ এর তৃতীয় খলিফা শায়খ হাজী আব্রু মিঞা চৌধুরী রঃ এর পঞ্চম পুত্র হাফিজ শফিকুর রাহমান চৌধুরী রঃ এর ঔরসে 21 ডিসেম্বর 1955 ইংরেজী সনে
ঐতিহ্যবাহী কানাইঘাট থানার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব তালবাড়ী গ্রামে ( দলইচটি ) এক দ্বীনদার ফ্যামিলিতে জন্ম গ্রহণ করেন ।
পিতা : হাফিজ শফিকুর রাহমান সাহেব ।
মাতা: মোছাম্মত করিমা বিবি ।
#শিক্ষা : মৌলিক শিক্ষা নিজ মাতা পিতার কাছে ও মসজিদের মক্তবে অর্জন করে একাডেমিক শিক্ষা অর্জন করার লক্ষ্যে তালবাড়ী বীরদল নেছারিয়া ফয়জে আম মাদ্রাসায় ভর্তি হোন ।
মুতাঃ 4র্থ বর্ষ পর্যন্ত ফয়জে আম মাদ্রাসায় শিক্ষা অর্জন করে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করার লক্ষ্যে বিশ্বনাথ মাদানিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হোন , একাধারে 2 বতসর লেখাপড়া করেন । বিশ্বনাথ মাদানিয়ায় দুই বত্সর লেখাপড়া করে সিলেটের দরগাহ মাদ্রাসায় ভর্তি হোন, সেখানে ফযিলত 1ম বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন ।
1975 ইংরেজী সনে দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় ফযিলত 2য় বর্ষে ভর্তি হোন ।
1977 ইংরেজী সনে কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরায়ে হাদীস সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ( 1ম বিভাগে) সমাপন করেন ।
1978 সালে লেখাপড়া পড়া শেষ করে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করার লক্ষ্যে দারুল উলূম দেওবন্দ যাওয়ার ইচ্ছা করে ভিসা জটিলতায় ভাগ্যে জুটেনি!, তার পর ভর্তি হোন হাটহাজারী মাদ্রাসায় । এক বত্সর সেখানে তাফসির বিভাগে অধ্যয়ন করেন
#শিক্ষকতা: 1979 সালে দেওবন্দ যাওয়ার জন্য পেরেশান হয়ে পড়েন! তখনি দারুল উলূম দেউলগ্রাম মাদ্রাসার মাননীয় মুহতামীম মাওলানা আব্দুল মুছব্বির সাহেবের পিড়াপিড়িতে দারুল উলূম দেউলগ্রাম মাদ্রাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হোন এবং 1992 সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করেন, সম্ভবত কিছুদিন সেখানে শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন ।
1995 ইংরেজী থেকে 2000 সাল পর্যন্ত সিলেটের নয়া সড়ক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন । এবং কয়েক বছর শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব আঞ্জাম দেন ।
1992 থেকে 1995 পর্যন্ত ব্যবসার কারণে দ্বীনী খিদতাম থেকে দূরে থাকেন ।
#ব্যবসা: 1989 সাল থেকে শিক্ষকতার পাশাপাশি ব্যবসা বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন, প্রতিষ্ঠা করেন সিলেটের কুদরতুল্লাহ মার্কেটে #মাদানিয়া_কতুব_খানা! ।
কৌমী অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত মুখ হওয়ার সুবাদে অল্প দিনের মধ্যে মাদানিয়া কতুব খানা সিলেটের উলামায়ে কেরামদের কাছে বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে ।
1992 সালে দেউলগ্রাম মাদ্রাসা থেকে বিদায় নিয়ে সিলেটের জিন্দাবাজারস্ত বর্তমান রয়েল হস্পিটালে #মুনলাইট হুস্টেল নামে যৌত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করেন! , যেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যৌত হওয়ার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুসকানের দিকে এগুতে থাকে ! ।
1995 ইংরেজী সনে মুনলাইট হুস্টেল লুসকানের কারণে ছাড়তে বাধ্য হোন ! এবং সেই লুসকান কাটিয়ে উঠতে স্বপ্নের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মাদানিয়া কতুব খানা বিক্রি করেন!।
একদিকে ব্যবসায় ধ্বস! একেবারে দিশেহারা! এখন কি করবেন সেই চিন্তায় বিভোর! , সিলেটের কয়েকটি নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকতা করার জন্য অপার আসছে , শেষ পর্যন্ত সিলেটের নয়া সড়ক মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত হোন এবং শিক্ষকতার পাশাপাশি সিলেটের মধুবন মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় আদর ফ্যাশন ও তান্দুরী রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন । 1995 সাল থেকে 2000 সাল পর্যন্ত সিলেটের নয়া সড়ক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও মধুবন মার্কেটে দুইটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছিলেন ।
2000 সালে অসুস্থতার কারণে নয়া সড়ক মাদ্রাসা থেকে বিদায় নিয়ে বাড়িতে চলে যান !। এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার মতো আমরা কেউ না থাকার কারণে ( তখন আমরা ভাইয়েরা শিক্ষার্জনে ব্যস্ত! ) ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য হোন ।
কুদরত উল্লাহ মার্কেটের বর্তমান নিউ মাদানিয়া কুতুব খানা ! তখনকার সময়ের মাদানিয়া কুতুব খানার কথা মণে হলে অনেক কষ্ট হয়! , আজকে সেই কুতুব খানা থাকলে প্রবাসে থাকতে হতো না ! , এটা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ।
#সহপাঠী:
1/ মরহুম মাওলানা আবুল কালাম যাকারিয়া সাহেব রঃ
2/ জামেয়া কারাচির সহকারী মুফতি মুফতি আব্দুল মান্নান দাঃবাঃ
3/মাওলানা আব্দুল মুছব্বির সাহেব মুহতামীম দয়ার বাজার কলাবাড়ী প্রমুখ ।
#শিক্ষকবৃন্দ :
1/ মাওলানা রফিক আহমদ বড় মেছার রঃ
2/ মাওলানা আবুল হাসান হুরু মেছাব রঃ
3/ মাওলানা তায়্যিবুর রহমান রঃ
4/ মাওলানা মুফতি রহমতুল্লাহ সাহেব রঃ
5/শায়খুল হাদীস মাওলানা কুতুবউদ্দিন সাহেব রঃ
6/শায়খুল হাদীস মাওলানা ইসহাক রঃ
7/ মাওলানা আব্দুল মুছব্বির দাঃবাঃ প্রমুখ ।
#শিক্ষকতা জীবনের সুনাম: 1980 সাল সবেমাত্র শিক্ষকতা জীবনের দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ!, পাঠদান পদ্ধতি আর সুন্দর উপস্থাপনায় দেউলগ্রাম মাদ্রাসা এরিয়ায় মাওলানা ফরিদ উদ্দীন সাহেবের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে! শিক্ষক ছাত্র এলাকাবাসী সকলের কাছে তালবাড়ী! এমতাবস্থায় শায়খে রেঙ্গা রঃ রেঙ্গার দাওরায়ে হাদীসের কয়েকজন ছাত্র নিয়ে দেউলগ্রাম এলাকায় তাবলীগে আসেন, দেউলগ্রাম এলাকায় এসে সকলের মুখে তালবাড়ীর কথা শুনে শ্রদ্ধেয় চাচাজানের সাথে দেখা করার জন্য আগ্রহী হোন , দেখা হওয়ার পর রেঙ্গা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করার প্রস্তাব দেন , একপর্যায়ে দেউলগ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে রেঙ্গায় চলে যাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করেন শায়খে রেঙ্গা রঃ ।
শ্রদ্ধেয় চাচাজী নিরুপায় হয়ে শায়খে রেঙ্গা রঃ কে দেউলগ্রাম মাদ্রাসা থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য বললেন!, শায়খে রেঙ্গা রঃ দেউলগ্রাম মাদ্রাসার মুহতামীম মাওলানা আব্দুল মুছব্বির সাহেবের কাছে চাচাজানের বিদায় চাইলে দেউলগ্রাম মাদ্রাসার মুহতামীম সাহেব আদবের সহীত তা প্রত্যাখ্যান করেন!। শায়খে রেঙ্গা রঃ নিরুপায় হয়ে শেষে ওয়াদা করান যদি আপনি কোনদিন দেউলগ্রাম থেকে বিদায় নেন তাহলে বিদায় নিয়ে রেঙ্গায় চলে আসবেন । শ্রদ্ধেয় চাচাজী সেই ওয়াদায় আবদ্ধ হন । দেউলগ্রাম থেকে বিদায় নিয়ে নয়া সড়ক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন তখন শায়খে রেঙ্গা রঃ দুনিয়াতে না থাকার কারণে সেই ওয়াদা পুরন করতে পারেন নি !। শ্রদ্ধেয় চাচাজী মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে আমরা ভাইদেরকে নসিহত করতে গিয়ে এই ঘটনা বর্ণনা করেন এবং আমাদের জীবনে যোগ্যতা অর্জন করতে বলেছিলেন, যদি যোগ্যতা অর্জন করো তাহলে তুমি খেদমত খুজতে হবে না , খেদমত তোমাকে খুঁজবে ।
#বিবাহ : 1986 ইংরেজী সনে ঝিংগাবাড়ী ইউনিয়নের কোনা গ্রামের মাওলানা আহমদ আলী সাহেবের মেয়ে মোছাম্মত রুশনা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হোন।
দাম্পত্য জীবনে তিনি 4 ছেলে ও দুই মেয়ের জনক।
#ছেলে
1/ হাফিজ মাওলানা ফুজায়েল আহমেদ ইমরান । কাতার প্রবাসী
2/ হাফিজ মারজান আহমদ । শিক্ষার্থী দাওরায়ে হাদীস বসুন্ধরা ঢাকা ।
3/ হাফিজ রায়হান আহমদ । সৌদী আরব প্রবাসী
4/ রোমান আহমদ । শিক্ষার্থী ঝিংগাবাড়ী দারুল কোরআন হাফিজিয়া মাদ্রাসা ।
#মেয়ে
1/ মোছাম্মত মাহবুবা আক্তার ফেরদাউস
2/ মোছাম্মত শাহিবা আক্তার হুমাইরা
#সামাজিকতা : আচারব্যবহারে অত্যন্ত নম্র ভদ্র ছিলেন যার কারণে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সাথে স্থান কাল পাত্র ভেদে সুসম্পর্ক ছিল । আচার ব্যবহারে স্থান করে নিয়েছিলেন মানুষের হৃদয়ে । দেউলগ্রাম এলাকায় প্রতিটি পরিবারের সাথে যার ছিল গভীর সম্পর্ক! সবাইকে তিনি ভালোবাসতেন সবাই ও তিনাকে ভালোবাসতো ।
#চলাফেরা : চলাফেরায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সকীন সুগন্ধি ব্যবহারে যার তুলনা কেহ হয় না ! যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন সেই রাস্তায় অনেকক্ষণ সুগন্ধি যে কেউর নাকে লাগতো । দরগাহ মাদ্রাসার বর্তমান মুহাদ্দীস শ্রদ্ধেয় চাচাজানের সমবয়সী উস্তাদে মুহতারাম মাওলানা সালেহ আহমদ জকিগঞ্জ দাঃবাঃ প্রায় আমাকে বলতেন জাহিদ তুমার চাচা যখনই শুনতেন নতুন সুগন্ধি আতর এসেছে সর্বাগ্রে তিনি তা ক্রয় করতেন আর আমরা তার কাছ থেকে লাগাতাম । চাচাজীর কিডনিতে পাথর ছিল ! তিনবার অপারেশন করা হয়েছিল । মাওলানা সালেহ আহমদ জকিগঞ্জ দাঃবাঃ প্রায় বলতেন ফরিদ উদ্দীন সাহেবের অসুস্থতা এই আতর থেকে হয়েছে! কারণ তিনি অতিরিক্ত সুগন্ধি ব্যবহার করতেন ।
#রাজনৈতিক মতাদর্শ: মাদানী রঃ এর খলিফার ঔরসে জন্ম গ্রহণ করার ফলে মাদানী পরিবার ও জমিয়তের প্রতি ভালোবাসা অন্তরে লালন করতেন । সম্ভবত আশির দশকে উনার মাধ্যমে সাবেক এমপি মাওলানা ফরিদ উদ্দীন চৌধুরী সাহেবের সাথে কোনাগ্রাম আননূর জামে মসজিদে আদালতে সাহাবা সম্পর্কে মুনাযারা হয়েছিল । সেই মুনাযারায় শায়খে পারকুলি রঃ বিচারক ছিলেন ।
মাদানীর খলিফার বংশে জন্ম গ্রহণ করার ফলে মাদানী পরিবারের প্রতি এতটাই দুর্বল ছিলেন যে প্রতিটি প্রদক্ষেপে মাদানী রঃ প্রতি ভালোবাসা দেখাতেন যার ফলে কুদরত উল্লাহ মার্কেটে যখন লাইব্রেরি ব্যবসা শুরু করেন তখন তার নাম দেন মাদানিয়া কুতুব খানা । মাদানী রঃ এর ভালোবাসার কারণে অন্তরে স্বপ্ন লালন করতেন যে বাড়ির প্রবেশ ধারে মাদানী মঞ্জিল লিখে সাইনবোর্ড টানাতে! কিন্তু উনার জীবদ্দশায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেন নি ! আল্লাহ্ পাক তাউফিক দিলে আমরা উনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ্ ।
#সামাজিক সংগঠন: রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সামাজিক অনেক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন যার মধ্যে আননেছার একাডেমিক ও আল ইহসান আদর্শ কাফেলার পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন ।
#মৃত্যু: 26 এপ্রিল 2009 ইংরেজী রোজ রবিবার রাত 9:20 মিনিটের সময় নিজ বাসস্থানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । ইন্না লিল্লাহি অইন্না ইলাইহি রাজিউন ।
মৃত্যুকালে তিনি 6 ভাই 3 বোন স্ত্রী ও 4 ছেলে ও 2 মেয়ে সহ বিশুর্ধ ভাতিজা ভাতিজি ভাগনা ভাগনি ও আত্মীয় স্বজন ও হিতাকাঙ্ক্ষী রেখে পরপারে চলে জান ।
দোয়া করি আল্লাহ্ পাক শ্রদ্ধেয় চাচাজান কে জান্নাতের সুউচ্চ মকাম দান করেন । আমীন