সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

মুফতি দিলওয়ার হোসাইন দা. বা. এর সংক্ষিপ্ত জীবন দর্শন

November 09 2020, 04:30

নাম :- দিলাওয়ার হোসাইন

স্মরণীয় দ্বীনের কান্ডারী তাঁদের প্রতিভাদ্বীপ্ত জীবন ও অবিস্মরণীয় অসামান্য অবদানের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহের দিক-নির্দেশক জ্যোতিষ্কের ন্যায় অনুকরণীয়, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমে দ্বীন, প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন, শ্রেষ্ঠ মুফতী, অভিজ্ঞ ফকীহ, বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতী দিলাওয়ার হোসাইন দা. বা. তাঁদের অন্যতম।

তাঁর ব্যস্ততম জীবনে তিনি ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা, যুগ চাহিদার শরয়ী সমাধান, বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান গ্রন্থ রচনা, জ্ঞানের প্রচার-প্রসার ও পৃষ্ঠপোষকতা, ওয়ায-নসীহত এবং আধ্যাত্মিকতার এক বিরল ব্যক্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আমাদের জন্য এক অনুপম আদর্শ।

জন্ম ও বংশ :
বাংলাদেশে ১২৫৪ খৃষ্টাব্দে হযরত শাহ জালাল মুজাররাদে ইয়ামানী (রহ.) এর সাথে ইয়ামান থেকে ৩৬০ জন আউলিয়ায়ে কিরামের আগমন ঘটে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন হযরত মোল্লা দিওয়ান শাহ (রহ.) তাঁরই বংশের অধঃতন ১১তম পুরুষ হলেন আল্লামা মুফতী দিলাওয়ার হোসাইন দা. বা.। তাঁর পিতার নাম হযরত মাওলানা দ্বীন মুহাম্মাদ (রহ.) তিনি বাংলাদেশের অন্যতম জেলা কুমিল্লার অন্তর্গত মনোহরগঞ্জ সাবেক লাকসাম থানাধীন বান্দুয়াইন গ্রামের মোল্লাবাড়ীতে ১৩৮৪/১৩৮৬ হিজরীতে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

ইলমে দ্বীন অর্জন ও শিক্ষা জীবন :
তিনি চার বছর বয়সেই তাঁর আম্মাজান, বড় ভাই মৌলভী মুহিব্বুল্লাহ ও সেজ ভাই মাওলানা নুরুল্লাহ এবং তাঁর আব্বাজানের কাছে কুরআনে কারীম পড়া শেখেন। সে বছরেই অর্থাৎ ১৩৮৭ হি. মোতাবেক ১৯৬৭ ঈ. সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখানে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।

এরপর ১৩৯৪ হি. মোতাবেক ১৯৭৩ ঈ. সালে জামি‘আ হুসাইনিয়া মাদানিয়া মুনশিরহাট মাদরাসায় ভর্তি হন এবং সেখানে আমাদের দেশের কওমী মাদরাসার প্রচলিত সিলেবাস এর অধীনে হিদায়াতুন নাহব জামাত (অষ্টম শ্রেণী) শেষ করেন। এ সময়ে প্রত্যেকটি পরীক্ষায় মুমতায তথা ষ্টার মার্ক নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেখানে উর্দূ ও ফার্সি ভাষা এবং এ দু‘ভাষায় রচিত বিভিন্ন বই-পুস্তক অধ্যয়ন করেন। মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরেই উর্দূ ও দ্বিতীয় বছরে ফার্সী ভাষায় তাঁর আব্বার কাছে চিঠিপত্র লেখা আরম্ভ করেন। মাদরাসার প্রাথমিক এ পাঁচ বছরে তিনি উর্দূ ও ফার্সী রচনাশৈলীতে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেন। এক্ষেত্রে তাঁর পৈতৃক দিক থেকে জন্মগত প্রভাবও কম ছিল না। কারণ তাঁর আব্বাজানও একজন বড় আলেম, কবি, বাগ্মী, ওয়ায়েয এবং ফার্সী ও আরবী ভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। ১৩৯৯ হি. মোতাবেক ১৯৭৮ ঈ. সালে ইত্তেহাদুল মাদারিস পটিয়া বাংলাদেশ (কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড) এর অধীনে অনুষ্ঠিত সপ্তম মারহালার কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এ মাদরাসায় তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর পড়ালেখা করেন।

এখানে উচ্চস্তরে আর কোন জামাত (শ্রেণী) না থাকায় তিনি ইস্তেখরার মাধ্যমে ১৩৯৯ হি. মোতাবেক ১৯৭৮ ঈ. সালে চাঁদপুর শাহ্রাস্তি থানার জামি‘আ ইসলামিয়া আরাবিয়া খেড়ীহর মাদরাসায় জামাতে কাফিয়ায় (নবম শ্রেণীতে) ভর্তি হন এবং সেখানে দীর্ঘ চার বছর ইলমে দ্বীন অর্জন করেন। বিশেষ করে সরফ, নাহব, ফিক্হ, উসূলে ফিক্হ, বালাগাত, মানতিক ইত্যাদি শাস্ত্রে খুবই পারদর্শীতা হাসিল করেন। তিনি সেখানেও সকল পরীক্ষায় মুমতায তথা ষ্টার মার্ক নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং পুরস্কৃত হন।

অতঃপর তিনি দ্বীনী ইলমের পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ১৪০৩ হি. মোতাবেক ১৯৮২ ঈ. সনে বাংলাদেশের অন্যতম ইসলামী বিদ্যাপিঠ ও ইলমী মারকায জামি‘আ কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ ঢাকায় জামাতে জালালাইন-এ ভর্তি হন এবং ১৪০৫ হি. মোতাবেক ১৯৮৫ ঈ. সালে দাওরা হাদীস (মাস্টার্স) শেষ করেন। সেখানে বড় বড় আলেমে দ্বীন বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও সুদক্ষ উস্তাদগণের নিকট ধারাবাহিকভাবে তিন বছর ইলম অর্জন করেন। একই ধারাবাহিকতায় সেখানেও তিনি কঠোর পরিশ্রম, চেষ্টা-মেহনত ও সাধনার মাধ্যমে ইলম ও মারিফাতের উচ্চ শিখরে উপনিত হতে সক্ষম হন। এখানেও প্রতি পরীক্ষায় পূর্বের ন্যায় মুমতায তথা ষ্টার মার্ক নিয়ে উত্তীর্ণ হন। দাওরায়ে হাদীসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রতি বিষয়ে কমপক্ষে ৪০ ও উর্ধ্বে ৬৫ পৃষ্ঠা পযন্ত লিখেছেন।
এ সময়ে তিনি ইলমে মা‘রিফাতের তৃষ্ণা ও পিপাসা উপলব্ধি করে প্রখ্যাত বুযুর্গ শায়খ মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর (রহ.) এর হাতে বায়‘আত গ্রহণ করেন।

উচ্চ শিক্ষা অর্জনে বিদেশ গমন :
উচ্চ শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ১৪০৫ হিজরী মোতাবেক ১৯৮৫ইং সনে পাকিস্তানের সাবেক রাজধানী করাচী গমন করেন। সেখানে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ সর্ববৃহৎ ইসলামী মারকায ‘জামি‘আ দাুরুল উলূম করাচী’ যাকে ‘পাকিস্তানের কর্ডোভা’ ও ‘পাকিস্তানের আযহার’ বলা হয়। দ্বীনি ইলমের উচ্চতর গবেষণামূলক সর্বোচ্চ স্তর ‘তাখাস্সুস ফিল ফিক্হ ওয়াল ইফতা’ (পিএইচ.ডি.) তথা ইসলামী আইনের উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা এবং দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাবলীর শরয়ী সমাধান প্রদান (ইফতা) বিভাগে ভর্তি হন। এখানেও তিনি পূর্বের ন্যায় ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, কঠোর পরিশ্রম, নিরলস অধ্যাবসায়, প্রচুর অধ্যয়ন, গভীর গবেষণা এবং ফাতওয়ার প্রশিক্ষণে নিবেদিত হন। প্রথম এক বছরেই অধ্যয়ন করেন প্রায় দশ হাজার পৃষ্ঠা। ফলে ইলমের গভীর সাগরে পৌঁছার জন্য ব্রত হলেন শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী (দা. বা.) এর সূদীর্ঘ ১১ বছরের অবিচ্ছেদ্য সান্নিধ্য গ্রহণের মাধ্যমে। এখানেও তিনি প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং দুই পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান ছাড়া বাকী সকল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন।

অতঃপর ফিকহে হানাফীর মূলনীতি বিষয়ক এক অনবদ্য কিতাব ‘আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ির’ এর প্রথম অংশের ৪র্থ কায়েদা হতে শেষ কায়েদা পযন্ত ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করেন ছয় খন্ডের আঠারশ’ পৃষ্ঠার এক বিশালাকার দফতরে। যা ছিল তাঁর অভিসন্দর্ভ বা থিসিসপত্র। যখন তিনি এর ছয় খন্ড পূর্ণ করে ১৪১০ হিজরীতে শাইখুল ইসলামের কাছে জমা দেন, তখন তাঁর পাশে থাকা মাকতাবায়ে দারুল উলূম করাচীর নাযেম বলেছিলেনঃ
“আমার জানামতে এ থিসিসপত্রটি জামি‘আয় এ যাবত জমা হওয়া থিসিসপত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় থিসিসপত্র”।
শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী (দা. বা.) এই থিসিসপত্রটির দুই খন্ড দেখার পর একদিন তাঁর পিঠে মমতা মাখা ও আদর ভরা হাতে থাপ্পড় মেরে বললেনঃ
“আমি তার দু‘খন্ড পড়ে দেখেছি, তা আমার মনকে ভরে দিয়েছে খুশিতে, আর চক্ষুদয়কে ভরে দিয়েছে শীতলতায়”।
তাঁর এই মাকালা দেখেই হযরত শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী (দা. বা.) তাঁকে জামি‘আ দাুরুল উলূম করাচীতে নিয়োগের প্রস্তাব দেন এবং পরবর্তীতে তা কার্যে পরিণত করা হয়।

আধুনিক অর্থনীতি শিক্ষা
১৪১১ হি. মোতাবেক ১৯৯১ ঈ. সালে শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী (দা. বা.) এর কাছে তিনি “আধুনিক অর্থনীতি” কোর্স সম্পাদন করেন।

সাধারণ শিক্ষায় ডিগ্রী অর্জন
তিনি দ্বীনী ইল্ম হাসিলের পাশাপাশি সরকারী সাধারণ শিক্ষায়ও ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন। এক কথায় তিনি দ্বীনী ও পার্থিব উভয় শিক্ষারই সমাবেশ। তিনি পাকিস্তানের জেনারেল শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৮৭ ঈ. মোতাবেক ১৪০৭ হি. সনে এস.এস.সি. পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। এরপর ১৯৮৯ ঈ. মোতাবেক ১৪০৯ হি. সনে এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৯১ ঈ. মোতাবেক ১৪১১ হি. সনে ডিগ্রী পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ অর্জন করেন। এ পরীক্ষাগুলোর জন্য তাঁকে মাদরাসা থেকে ছুটি নিতে হয়নি। এস.এস.সি পরীক্ষার সময় মাদরাসার বার্ষিক পরীক্ষার ছুটি ছিল। যেদিন ইফতা ২য় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হয় এর পরদিন থেকে এস.এস.সি পরীক্ষা শুরু হয়। আর বাকি এইচ.এস.সি ও ডিগ্রী পরীক্ষার সময় তিনি দারুল উলূমের রচনা বিভাগের সদস্য ও উস্তাদ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। যোহর থেকে মাগরিব পযন্ত মাদরাসার পক্ষ থেকে তার উপর কোন দায়িত্ব ছিল না। আর পরীক্ষাগুলো হতো ২টা থেকে ৫টা পযন্ত। তিনি এ সময় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতেন। ডিগ্রী পরীক্ষার মাত্র ১৫ দিন পূর্ব থেকে মাদরাসার দায়িত্বের ফাঁকে ফাঁকে এ সংক্রান্ত লেখা-পড়া আরম্ভ করেন ও পরীক্ষায় অংশ নেন। ফলে তাঁকে এর জন্য কোন ছুটি নিতে হয়নি।

শিক্ষা পরবর্তী জীবন ও কর্ম :
১৯৯০ ঈ. মোতাবেক ১৪১০ হিজরীতে জামি‘আ দাুরুল উলূম করাচী থেকে পাস করে বের হওয়ার পর প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা করেন। যে মাতৃভূমি, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে বিদেশে সুদীর্ঘ পাঁচটি বছর অতিক্রম করেছেন। তাই তিনি তাঁর শায়খ ও মুর্শিদ শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. এর কাছে যান ও মনের অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন। শায়খুল ইসলাম এত বছর যাবত তাঁর মাঝে লক্ষ্য করেছেন আশার নিদর্শন, আভিজাত্য ও শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ, নিরীক্ষণ করেছেন তাঁর ইলম-আমল ও তাকওয়া এবং পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁর উৎকর্ষ স্বভাব-চরিত্র ও ভদ্রতা। তাই তিনি তাঁকে বললেনঃ
“তোমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?”
তদুত্তরে তিনি বললেনঃ এখন তো দেশে যেতে মন চায়, পরবর্তীতে মুরব্বীদের যা পরামর্শ হয় তাই করব। একথা শুনে তিনি বললেনঃ
“পুনরায় ফিরে এসো, তুমি এখানেই থাকবে।”
অন্যদিকে তাঁর সহীহ বুখারী ও সুনানে তিরমিযীর উস্তাদ ও মুরব্বী হযরত শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব দা. বা. করাচীর এক সফরে গিয়ে তাঁকে বলেছিলেনঃ
“দিলাওয়ার! দেশে ফিরে আসলে আমার সাথে কথা বলা ব্যতীত অন্য কোথাও খেদমতের জন্য কথা দিওনা।”
তাই তিনি স্বদেশ ও মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে এসে তাঁর মুরব্বী শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক দা. বা. এর সাথে সাক্ষাত করতে যান। হযরত শায়খুল হাদীস তখন জামি‘আ রহমানিয়ার সামনে বসে উযূ করছিলেন। তাঁকে দেখেই বললেনঃ
“তুমি দেশে এসেছ? ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী?”
তিনি উত্তরে হযরত শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. এর কথাটি শুনালেন যে, তিনি দাুরুল উলুম করাচী ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছেন। তাঁর কথাটি শুনা মাত্র তিনি বললেনঃ
“পুটি মাছের কল্লা খাওয়ার চেয়ে
কাতল মাছের লেজ খাওয়া ভাল।”

এ কথা বলে তিনি পুনরায় পাকিস্তান যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করলেন। অর্থাৎ এ দেশে থাকলে বড় বড় কিতাব পড়ানোর সুযোগ হবে। আর সেখানে হয়ত প্রথমে ছোট কিতাব পড়াতে হবে, তথাপিও সেখানে থাকা ভাল হবে।
এরপর তিনি তাঁর শায়খ ও মুর্শিদ শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. এর কাছে পত্র মাধ্যমে যোগাযোগ করে তাঁর সান্নিধ্যে পুনরায় ফিরে যাওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। অতঃপর যখন দাুরুল উলূম করাচীতে গিয়ে উপস্থিত হন তখন শায়খুল ইসলাম তাঁর প্রেরিত পত্রের পাশে তাঁকে জামি‘আর দাুরুত তাসনীফের (রচনা বিভাগের) সদস্য হিসেবে নিয়োগ দানের কথা লিখে দেন। যাতে তিনি “আল আশবাহ ওয়ান নাযায়ির” (الأشباه والنظائر) কিতাবের অবশিষ্টাংশের ব্যাখ্যার কাজ শেষ করতে পারেন এবং পুরো অংশের ব্যাখ্যা একই নিয়ম ও ধাঁচে সজ্জিত হয়। তাই তিনি ১৯৯১ ঈ. মোতাবেক ১৪১১ হিজরীর ১৫ই রবিউল আওয়াল তারিখ থেকে এই মহতি কাজ সম্পাদনে আত্মনিয়োগ করেন এবং উক্ত কিতাবের শুুরু হতে দ্বিতীয় কায়দার শেষ পযন্ত ব্যাখার কাজ বিশালাকায় চার খ-ে বারশ পৃষ্ঠায় সম্পাদন করেন। এর পাশাপাশি মুফতীয়ে আযম পাকিস্তান মুফতী রফী উসমানী দা. বা. ও শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. এর বিভিন্ন মাকালা ও রচনাবলীতে সহযোগিতা করতেন।

এ সকল কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদের এবং বিভিন্ন উস্তাদের জন্য বিভিন্ন জটিল ও দুর্বোধ্য মাসআলা সমূহের সমাধান পেশ করতে ও এর উদ্ধৃতি-কিতাব খুজে দিতে অনেক সময় ব্যয় করতেন। যার কারণে তাঁর উস্তাদ হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুল্লাহ সাহেব (বার্মী) তাঁর নাম রেখেছিলেন “উকদা হল” তথা জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়ের সমাধানকারী। তাছাড়াও ১৪১৪-১৪১৬ হিজরী পযন্ত দুই বছর ইলমে নাহব ও ইলমে সরফ প্রভৃতি শাস্ত্রের বিভিন্ন কিতাব পড়ানোর দায়িত্বও পালন করেন।
এখানে সর্বপ্রথম প্রাপ্ত বেতনের কিছু অংশ দাুরুল উলূম করাচীরই বোর্ডিং-এ আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি কল্পে দান করেন।

এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর কাটানোর পর তিনি তাঁর মায়ের সাথে সাক্ষাতের লক্ষ্যে ১৯৯৫ ঈ. মোতাবেক ১৪১৬ হি. দেশে ফিরে আসেন। অতঃপর তাঁর অত্যন্ত স্নেহ পরায়ণ ও মমতাময়ী মা তাঁকে আর পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেননি।
এদিকে তিনি এবং তাঁর নিকটতম বন্ধু ও সহপাঠী মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ও তাঁরই সহোদর মুফতী আবদুল মালেকের করাচী থাকা কালে দেশে ফিরে এসে সুন্দর ও মান সম্পন্ন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করতেন। এই পরিকল্পনাকে সমনে রেখে মুরব্বীদের পরামর্শক্রমে তাঁরা আল্লাহ পাকের উপর পূর্ণ ভরসা করে উপকরণবিহীন অবস্থায় ঢাকার মুহাম্মাদপুরে একটি ভাড়া বাড়ীতে ১৯৯৫ ঈ. মোতাবেক ১৪১৬ হি. সনে “মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া ঢাকা” নামে একটি নবধারার প্রতিষ্ঠানের সূচনা করে তাদের পূর্বের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। তাঁরা সকলে এই প্রতিষ্ঠানে দ্বীনী ইলমের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে নিজেদের জান-মালকে বিসর্জন দেন।

আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, তারা এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে, এক বছর পযন্ত তাঁরা দরস (পাঠ) দানের কোন বিনিময় গ্রহণ করবেন না। তাঁদের এই ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলে এই প্রতিষ্ঠান আজ বাংলাদেশের আনাচে কানাচে বরং বিদেশেও সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
আল্লামা মুফতী দিলাওয়ার হোসাইন সাহেব দা. বা. সেখানে দীর্ঘ ছয় বছর শিক্ষকতা, দরস, ফাতাওয়া তথা সারা দেশের বিভিন্ন সমস্যাবলীর সমাধান প্রদান এবং জনসাধারণকে সুন্দর উপস্থাপনা ও সাবলীল ভাষায় ওয়ায-নসীহত এর মধ্যে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। বিশেষভাবে আধুনিক মাসআলা-মাসাইল ও নব উদ্ভাবিত সমস্যাবলী এবং জটিল-দুর্বোধ্য বিষয়াবলীর সমাধান পেশে সকলের কাছে সমাদৃত হন। যার ফলে তাঁর সাহচর্যে এসে বহু ইলম পিপাসুরা শুধু তাদের পিপাসাই নিবারণ করেনি বরং অন্য ইলম পিপাসুদের পিপাসা নিবারণের পাথেয়ও জোগাড় করে নিয়েছেন।

এরই মাঝে তিনি ২০০০ ঈ. সনে মিরপুরের ১নং সেকশনে গড়ে তুললেন একটি বৃহৎ ইসলামী প্রতিষ্ঠান, যার নাম রাখলেন “জামি‘আ ইসলামিয়া দাুরুল উলূম ঢাকা” এই প্রতিষ্ঠানটির বাউন্ডারির ভিতরস্থ মসজিদে (মসজিদুল আকবার) তিনি ১৯৯৮ ঈ. সন থেকে অদ্যাবধি খতীব হিসাবে নিয়োজিত রয়েছেন। এখানে তিনি প্রথম স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদীস ও তাখাস্সুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা বিভাগ পযন্ত ক্লাস চালু করেন। আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপায় মাত্র দু’বছরের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানটি আলেম-উলামা, মাদরাসার তালিবে ইলম, জেনারেল শিক্ষিত-অশিক্ষিত সর্বশ্রেণীর মানুষের আস্থার প্রতিক ও সকল সমস্যার শরয়ী সমাধানের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং এ যাবতকাল পযন্ত তার ঐতিহ্য ও সুনাম-সুখ্যাতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
এভাবে কয়েকটি বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ২০০৭ ঈ. সালে ইলমে দ্বীনের উচ্চতর গবেষণামূলক শিক্ষার সর্বোচ্চস্তরের পাঁচটি বিভাগ চালু করেন। বিভাগগুলো যথাক্রমে-
[১] আত তাখাস্সুস ফী উলূমিল কুরআন ওয়া তাফসীরিহী (তাফসীর বিভাগ)
[২] আত তাখাস্সুস ফিল হাদীসিশ শরীফ (হাদীস বিভাগ)

[৩] আত তাখাস্সুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা (ফিকহ ও ইফতা
বিভাগ)
[৪] আত তাখাস্সুস ফিল লুগাতিল আরাবিয়্যা ওয়া আদাবিহা
(আরবী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ) ও
[৫] আত তাখাস্সুস ফিস সীরাতি ওয়াত তারীখ (ইতিহাস বিভাগ)
প্রতিটি বিভাগই দু’বছরের মেয়াদে সুউচ্চ মানের কারিকুলামে সন্নিবেশিত এবং সুচাুরুরূপে পরিচালিত। তন্মধ্য হতে ৫ম বিভাগটি আমাদের জানা মতে ইতিপূর্বে এই ভারত উপমহাদেশে আর কোথাও চালু করা হয়নি।
তিনি অতি সুনাম-সুখ্যাতি ও দক্ষতার সাথে অত্র জামি‘আর প্রিন্সিপাল, শায়খুল হাদীস এবং আত তাখাস্সুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা বিভাগের চেয়ারম্যান ও প্রধান মুফতী হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

২০০৬ ঈ. সালের রমযান মাসে “মারকাযুল বুহূস আল ইসলামিয়া ঢাকা” এর সূচনা করেন। আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে এটিও বর্তমানে ইলমী তাহকীক, উচ্চতর গবেষণা ও আধুনিক সমস্যার সমাধানে সর্বস্তরের আলেম-উলামা ও সর্বশ্রেণীর মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত হয়েছে। সূচনালগ্ন থেকেই এখানে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মেধাবী ও জ্ঞানপিপাসু তালিবে ইলমরা ভিড় জমাচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে ইলমী তাহকীক ও গবেষণার ঝা-া নিয়ে। এসব কিছু মূলতঃ আল্লাহ পাকের অশেষ কৃপায় আর আল্লামা মুফতী দিলাওয়ার হোসাইন সাহেব দা. বা. এর ইখলাছ, তাকওয়া-পরহেযগারী, বিনয়-নম্রতা ও ইলমী ময়দানে পা-িত্য এবং অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হওয়ার বরকতে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর হায়াত ও দ্বীনী খেদমতে আরও বেশি রবকত দান কুরুন। আমীন!

২০০০ঈ. সনে তিনি নিজ গ্রাম বান্দুয়াইনে “দাুরুল উলূম বান্দুয়াইন” নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

এ ছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সবগুলি তাঁরই তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশনায় পরিচালিত হয় এবং সেগুলির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসাবেও তিনি অধিষ্ঠিত আছেন।

তথ্য দানকারীর নাম :- সংকলনে: মুফতি মাসুম বিল্লাহ (এই লেখাটি সংগৃহীত)

তথ্য দানকারীর মোবাইল :- ইমেইল: muftimasum87@gmail.com

Spread the love