আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি
March 03 2021, 09:36
আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি
সংক্ষেপে জিরি মাদরাসা চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জিরিতে অবস্থিত একটি কওমি মাদ্রাসা বা বেসরকারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম কওমি মাদ্রাসা এটি। দারুল উলূম দেওবন্দের মূলনীতিকে ভিত্তি করে পরিচালিত হয় মাদ্রাসাটি। মুজাহেদে মিল্লাত শাহ মাওলানা আহমদ হাসান ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রতিষ্ঠা করেন।
ইতিহাস
মুজাহেদে মিল্লাত শাহ মাওলানা আহমদ হাসান শিক্ষাজীবনের শেষদিকে জামাতে উলার বছর নিজ এলাকা পটিয়াতে মুসলমান সন্তানদের বিশুদ্ধ ইসলামি আক্বীদা-বিশ্বাস শিক্ষা দিতে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ার চিন্তাভাবনা করেন। বাবা অসিউর রহমান এবং লজিং শিক্ষক মাস্টার আশরাফ আলীর পরামর্শে প্রথমে কৈয়গ্রাম অঞ্চলে একটি মাদ্রাসার ভিত্তি রাখেন। কিন্তু নানা প্রতিকূল প্রতিবেশে সেটি বেশিদিন স্থায়ীত্ব হয়নি।
তারপর তিনি দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) শেষ করে ১৯১০ ইংরজিতে প্রতিষ্ঠানটি জিরি এলাকায় স্থানান্তরিত করে প্রথমে “মাদ্রাসা হামিয়্যাতুল ইসলাম, জিরি” নাম দিয়ে “বাদাম” বৃক্ষের নীচে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে থাকেন। ইতোপূর্বে দেওবন্দ মাদরাসার কার্যক্রম ‘’আনার’’ গাছের নিচে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে তা “আল মাদ্রাসাতুল আরাবিয়্যা জিরি” এবং সময়ের আবর্তনে বর্তমানে যা “আল জামিয়াতুল আরবিয়াতুল ইসলামিয়া জিরি” নামে সর্বমহলে পরিচিত।
অবস্থান
জিরি মাদ্রাসা চট্টগ্রাম থেকে ১৮ কিলোমিটার পূর্বে পটিয়ার জিরিতে অবস্থিত। চট্টগ্রামের প্রধান সড়ক আরাকান রোড থেকে উত্তর দিকে মাদ্রাসার দূরত্ব মাত্র ৫ কি.মি.। মাদ্রাসার উত্তর দিকে রয়েছে খলিল মীর ডিগ্রি কলেজ এবং উত্তর-পূূূর্ব দিকে আছে জিরি খলিল মীর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়
অবকাঠামো
প্রবেশপথ
জামিয়ায় তিনটি প্রবেশপথ আছে। শাহী গেইট জামিয়ার উত্তর দিকে অবস্থিত। এর সামনের রাস্তা জিরি মাদ্রাসা রোড নামে পরিচিত। যা চট্টগ্রামের প্রধান সড়ক আরাকান রোডের সাথে সংযুক্ত। আরাকান রোডের মিলনস্থলে একটি তোরণ আছে। যার নাম বাবুল হাসান। জামিয়ার পূর্ব দিকের গেইটের নাম বাবে নূর। অন্যটি জামিয়ার পশ্চিম দিকে অবস্থিত, এর নাম বাবে তৈয়ব।[৯]
মসজিদ
জামিয়ার মাঝখানে একটি দৃষ্টিনন্দন মসজিদ রয়েছে। পুরাতন মসজিদের পরিবর্তে ২০১৮ সালের দিকে এই নতুন মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। এর নাম মসজিদে তওবা। ৩ তালার এই মসজিদে প্রায় ৫০০০ জন একত্রে নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদে ১টি বড় গম্বুজসহ কয়েকটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। রমজানে এই মসজিদে প্রায় ১৫০ জন ইতেকাফ থাকে। মসজিদের একটু দূরে উত্তর পাশে মাকবারায়ে আহমদ হাসান।[১০]
গ্রন্থাগার
২০১৮ সালের দিকে নতুন মসজিদটি নির্মাণ হলে পুরাতন মসজিদের ২য় তলাকে গ্রন্থাগারে পরিণত করা হয়। নিচতলা প্রাইমারি ছাত্রদের নামাজঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই গ্রন্থাগারে অনেক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থের সংগ্রহ আছে। গ্রন্থাগারের পরিচালক মিজানুর রহমান কাসেমী।
শিক্ষাভবন
জামিয়ার সর্ব দক্ষিণে আছে শিক্ষাভবন। জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা শাহ আহমদ হাসানের নামানুসারে এই ভবনের নাম রাখা হয়েছে ‘ক্বসরুল হাসান’। এটিই জামিয়ার বৃহৎ ভবন। বেশিরভাগ শ্রেণীকক্ষ এই ভবনে অবস্থিত। এর ৩য় তলায় আছে তাজবিদ ও ক্বিরাত বিভাগ।
ছাত্রাবাস
জামিয়ায় ৩ তলা বিশিষ্ট ২টি ও ২ তলা বিশিষ্ট ২টি ছাত্রাবাস আছে। উত্তর ভবনের ৩য় তলায় হেফজখানা ও এতিমখানা। পশ্চিমভবনের ২য় তলায় ফতোয়া বিভাগের শ্রেণীকক্ষ। মসজিদের উত্তর পাশে নবনির্মিত ভবনের ৩য় তলা ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর নিচতলা দারুল হাদিসের দরসগাহ।
মাঠ ও পুকুর
জামিয়ার ভিতরে ২টি মাঠ আছে। মসজিদ সংলগ্ন মাঠে দুইদিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলনসহ যাবতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অন্য মাঠটি শিক্ষাভবনের সামনে। জামিয়ার মালিকানাধীন ২টি পুকুর আছে। একটি শিক্ষাভবনের সামনে, অন্যটি শাহী গেইটের সামনে। আরেকটি পুকুর আছে আংশিক মালিকানাধীন, যা মৎস চাষে ব্যবহৃত হয়।
কার্যক্রম
জামিয়াই অধ্যয়নের ক্ষেত্রে এমন একটি পাঠ্যক্রম চালু করার লক্ষ্য রয়েছে যা ইসলামী ধর্মতত্ত্বের নিখুঁততার পাশাপাশি আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রয়োজন অনুসারে জ্ঞান অর্জনের সুযোগ দিতে পারে যাতে ফলপ্রাপ্তরা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে সামঞ্জস্য করতে পারে এবং তারা যেখানেই বাস করুক না কেন, নিজেকে ইসলামের যোগ্য অনুসারী এবং দেশের আদর্শ নাগরিক হিসাবে প্রমাণ করতে পারে। তদনুসারে, আরবী এবং মাতৃভাষাকে ইসলামী শরিয়াহর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার সাথে অধ্যয়নের পাঠ্যক্রমগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে যা শিক্ষার্থীদের একটি স্বনির্ভর মানুষ হিসাবে তাদের ক্যারিয়ার গড়তে সহায়তা করে। বর্তমানে এর ৬৫ জন শিক্ষক এবং ২৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছেন যার মধ্যে ১০০০ অনাথ। [১১] জামিয়াহ এই অঞ্চলের কয়েকটি ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধান করে যাতে তারা তাদের পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের উন্নতি করতে পারে।
শিক্ষার ধরণ ও বিষয়সমূহ
শতবর্ষী জিরি মাদ্রাসার একাডেমিক গ্রেড প্রাথমিক স্তর, মাধ্যমিক স্তর, উচ্চ মাধ্যমিক স্তর, স্নাতক স্তর, মাস্টার্স স্তর এবং তাহফিজুল কুরআন স্তর নিয়ে গঠিত। জামিয়াহ প্রযুক্তিগত জ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি সরবরাহ করে। শিক্ষাগত বিষয়গুলি হ’ল আল-কুরআন, আল- হাদীস, তাফসির, বালাগাত, আল-ফিকহ, উসুল-আল-ফিকহ, ফলসাফাহ, হিকমাহ, আরবি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য, মানতেক(যুুুক্তিবিদ্যা), তাজবিদ, ইসলামী দর্শন, তাহফিজ-আল -কুরআন, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান ইত্যাদি। এইগুলির পাশেই জামিয়াহ কিছু প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ কোর্স যেমন বুক বাইন্ডিং, টাইপিং, ওয়াচ রিপেয়ারিং, দর্জি কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে। বাকি কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগুলো বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়।
উচ্চতর বিভাগ
দারুল ইফতা
ফতোয়া ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ। জামিয়ার পূর্বভবনের ২য় তলায় এই বিভাগটি অবস্থিত। দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পাশের পর এই বিভাগে ভর্তির আবেদন করা যায়। কোর্সের মেয়াদ ১ বছর। মোট ৩ জন ইসলামী আইনজ্ঞের অধীনে বিভাগটি পরিচালিত হয়।
ক্বিরাত বিভাগ
ক্বেরাত ও তাজবিদ বিভাগ শিক্ষাভবনের ৩য় তলায় অবস্থিত। ২ জন ক্বারীর অধীনে এই বিভাগ পরিচালিত হয়। দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পাশের পর এই বিভাগে আবেদন করা যায়। কোর্সের মেয়াদ ১ বছর।
আরবি সাহিত্য বিভাগ
আরবি সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগ বা আদব বিভাগ। জামিয়ার উত্তর ভবনের ২য় তলায় এই বিভাগটি অবস্থিত। দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) পাশের পর এই বিভাগে আবেদন করা যায়। কোর্সের মেয়াদ ১ বছর। মোট ৩ জন আরবি ভাষাবিদের অধীনে বিভাগটি পরিচালিত হয়।
আচার্যবৃন্দ
বিভাগীয় প্রধান
প্রকাশনা
জামিয়ার বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে মাওলানা লুৎফর রহমানের সম্পাদনায় “আল হাসান” নামে একটি সাময়িকী বের হয়। এছাড়া “মাসিক আন নূর” নামে আরেকটি আরবি ম্যাগাজিন বের হয় যা সাময়িক বন্ধ রয়েছে।
জামিয়া কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত
জামিয়ার পৃষ্ঠপোষকতা ও অর্থায়নে এক শতাধিক মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
- আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া বায়তুল করিম ইছানগর – চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে অবস্থিত একটি দাওরায়ে হাদীস (মাস্টার্স) মাদ্রাসা। ২০০২ সালে জামিয়া কর্তৃক এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- জিরি মহিলা মাদ্রাসা – জিরি মাদ্রাসা সংলগ্ন কাজীর হাটে এই মাদ্রাসাটি অবস্থিত। কওমি শিক্ষায় মিশকাত শ্রেণী, সাধারণ শিক্ষায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত,স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের জন্য সর্টকোর্স বিভাগ, এতিম ছাত্রীদের জন্য এতিমখানা ও সেলাই প্রশিক্ষণের মত কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হয় এই মাদ্রাসায়।
- শারজাহ চ্যারিটি হাসপাতাল – আরব আমিরাতের চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনালের অর্থায়নে জামিয়ার মালিকানাধীন এই হাসপাতালটি ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকে
- শান্তিরহাট জিন্নুরাইন মসজিদ – পটিয়ার শান্তিরহাটে ব্যস্ততম জায়গায় কোন মসজিদ না থাকায় জামিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় মীর সুপার মার্কেটের নিচতলায় মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
- জামিয়াতুল কামালাত তালিমুল ইসলাম – চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলা বান্দরবানে ইসলামি শিক্ষার প্রসারে জামিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৮ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
পরিচালিত সংস্থাসমূহ
- জিরি ওয়েলফেয়ার সোসাইটি – সরজাহ চ্যারিটি ইন্টারন্যাশনালের সাথে আলোচনা করে ১৯৯৩ সালে জামিয়ার তৎকালীন পরিচালক মুসলিমদের উন্নতির জন্য দাতব্য সংস্থা হিসেবে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও শিক্ষক
- মুফতি আজিজুল হক – প্রতিষ্ঠাতা, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া।[১৭]
- আহমদুল্লাহ –– আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার প্রধান মুফতি ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমীর। (জ. ১৯৪১)
- আলী আহমদ বোয়ালভী – সুফি সাধক, পটিয়া।[১৮]
- আব্দুল ওয়াদুদ সন্দ্বীপি – জিরি মাদ্রাসার দীর্ঘ ৬০ বছরের মুহাদ্দিস।
- শাহ মোহাম্মদ তৈয়ব – ইসলামি পন্ডিত, আধ্যাত্মিক চিকিৎসক।[১৯]
- মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী – মুফতিয়ে আজম, বাংলাদেশ। সাবেক প্রধান মুফতি, জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিন্নুরি টাউন, করাচি,পাকিস্তান।
বর্তমান শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০০