মাওলানা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
July 06 2020, 05:22
লিখেছেন- মু’তাসিম বিল্লাহ সাদী
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য যে সকল আহলে ইলমগণ,ইলমে ওহীর জ্ঞান অর্জন করে কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক নিজে অন্যকে ও সমাজকে পরিচালনা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন,এবং যারা সর্বাবস্হায় হক্ব ও হক্কানিয়াতের ওপর সীসাঢালার প্রাচীরের ন্যায় অটল অবিচল থাকেন তাঁদের মধ্যে হযরত মাওলানা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী হাফিজাহুল্লাহ অন্যতম ৷ একাদ্বারে তিনি একজন শায়খুল হাদীস,মাদরাসা পরিচালক ,খতিব,সংগঠক ও বহুমাত্রিক জ্ঞানের ও গুণের অধিকারী ৷ আসলাফ ও আকাবিরদের রেখে যাওয়া একজন সুযোগ্য উত্তরসূরী ৷
জন্ম ও বংশপরিচয় : হযরত মাওলানা আলিমুদ্দীন হাফিজাহুল্লাহ সিলেট জেলার আলেম ওলামা জন্মগ্রহণের উর্বরভূমি নামে খ্যাত ও সুপরিচিত কানাইঘাট উপজেলার পৌর এলাকার দুর্লভপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও দ্বীনদার পরিবারে ১৯৪৭ সালের কোনো এক শুভক্ষণে জন্মগ্রহণ করেন ৷ ভাই-বোন ছয় জনের মধ্যে তিনি হলেন তৃতীয় ৷ তাঁর পিতা-মরহুম মুন্সী উবায়দুর রহমান একজন আল্লাহ ওয়ালা অত্যন্ত খোদাভীরু ও দ্বীনের খাঁটি পাবন্দ সহজ সরল লোক ছিলেন ৷ তিনি আজীবন মসজিদ ভিত্তিক দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন ৷ তাঁর মাতা-মরহুমা ফাতিমা বেগম একজন পর্দানশীন,দ্বীনদার ও আল্লাহ ওয়ালী মহিলা ছিলেন ৷ সেসময়েও আদর্শ ,সততা ও ধর্মপরায়নতায় এপরিবারটি ছিল বিশেষ ঐতিহ্যের অধিকারী ৷
দুর্লভপুর গ্রামের নামকরণ : তৎকালীন ভারতবর্ষের আসাম রাজ্যের অন্তর্গত ( বর্তমান জকিগঞ্জ উপজেলার ৬নং সুলতান ইউনিয়নের একটি পরিচিত গ্রাম হল গঙ্গারজল )গঙ্গারজল গ্রাম থেকে ১.জনাব দুর্লভ চৌধুরী ২. জনাব ওলি চৌধুরী ৩.জনাব চান মিয়া চৌধুরী ৪.জনাব ফাকি মিয়া চৌধুরী নামে তারা চার ভাই বর্তমান কানাইঘাট উপজেলার দু’কিলোমিটার পশ্চিমে এসে ভিটে বাড়ি করে বসতি স্থাপন করেন ৷ প্রবীন মুরববিদের দেওয়া তত্ত্ব অনুযায়ী তাদের চার ভাইয়ের বড় ভাই দুর্লভ চৌধুরীর নামানুসারে দুর্লভপুর গ্রামের নাম করণ করা হয় ৷ এই গ্রামের লোকজন অতীতকাল থেকেও ইসলামি তাহযিব ,তামাদ্দুন, ন্যায়, ইনসাফ ও সততার সাথে চলে আসছে ৷ এগ্রামের লোকজনও দ্বীনি যে কোনো কাজে খুবই আগ্রহী যা সর্বজন স্বীকৃত ৷ হযরত মাওলানা আসগর মুহাম্মদ রাহ. ফাজিলে ভারতের রামপুর মাদরাসাসহ অনেক বড় বড় আলেম ওলামা ও জ্ঞানী-গুনীজন অতীতে ও ছিলেন,বর্তমানেও আছেন এই গ্রামে ৷ ১৯২২সালে কানাইঘাটে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা লড়াইয়ে শাহাদত বরণকারী ছয়জনের একজন জনাব মুসা মিয়া ও ঐগ্রামের গর্বিত সন্তান ,আল্লাহ তাআলা তাকে শহিদী মর্যাদা দান করুন ও সকল মুর্দেগানকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম নসিব করুন,আমীন ৷ ( দুর্লভপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য ও কীর্তিমান ব্যক্তিবর্গদেরকে নিয়ে অন্যদিন দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করবো ইনশাআল্লাহ ) ৷
শিক্ষ জীবন : সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড ৷ শিক্ষা ছাড়া কোন দেশ -জাতি উন্নতি ও অগ্রগতির শিখরে পৌঁছতে পারে না ৷ যে জাতি তাদের আদর্শ শিক্ষা হতে বঞ্চিত তারা জাতি হিসেবে মৃত ৷ তাঁর পিতা-মাতার একান্ত ইচ্ছা ছিল আপন সন্তানকে একজন আদর্শ,চরিত্রবান ও সত্যিকারের দ্বীনে ইসলামের খাদেম হিসেবে গড়ে তোলার ৷ তাই তারা নিজের আকাঙ্খা পূর্ণ করার পদক্ষেপ হিসেবে মুখে ভাষা ফোটার পর গ্রামের সাবাহি মক্তবে ভর্তি করে দেন ৷ এখানেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা-দীক্ষার হাতেখড়ি ৷ সাথে সাথে দুর্লভপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন ৷ প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্হান অধিকার করেন ৷ প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি সিলেট জেলায় ৩য় স্হান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন ( উল্লেখ্য যে সেসময়ে দুর্লভপুর জামে মসজিদের ইমাম ও প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার ছিলেন মাওলানা আরব আলী রাহ. তিনি একই সাথে মসজিদের ইমাম ও স্কুল পরিচালনার গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দিতেন ৷ আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন ) ৷
ছোট বেলা থেকে তাঁর মেধা ও স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর যে কোন কঠিন থেকে কঠিনতর বিষয়গুলো তিনি সামান্য সময় অধ্যয়নেই সহজে আয়ত্ব করতে পারতেন ৷ তাই তাঁর প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকগণ তাঁর মেধা,মন ও স্মৃতিশক্তির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তাকে জাগতিক শিক্ষার জন্য কানাইঘাট গভর্ণমেন্ট হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন ৷ এখানে ৬ষ্ট শ্রেণি পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া করেন ৷ আল্লাহ যাকে জাতির রাহবার বানাবেন,দিক-বেদিক ছোটাছুটি জাতির পথপ্রর্দশক করবেন ৷ তাকে যেন অদৃশ্য থেকে কেহ হাতছানি দিয়ে ডাকছে হে আগত জাতির রাহবার ! তুমি জাগতিক শিক্ষা ছেড়ে ইলমে নববীর কাননে এসো,কুরআন হাদীসের শিক্ষার আলোয় আলোকিত হও ৷ জাতি তোমার দিকে চেয়ে আছে,অসংখ্য জ্ঞান পিপাসুরা তোমার জ্ঞানের আলোয় থেকে আলোকিত হবে ৷ অতঃপর তিনি কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসায় চলে আসেন, ভর্তি হন ছাফেলা ২য় বর্ষে ৷ শুরু হয় নতুন শিক্ষা-দীক্ষার পথ চলা ৷ কুরআন, হাদীস তাফসির,ফিকাহ মানতিক,বালাগত নাহবো ও সরফ এর জ্ঞানের সাথে সর্বাক্ষণ হয় বিচরণ করা ৷ কোরআন হাদীসের জ্ঞানের এ বীর ডুবরি ছাত্রজীবনের শুরুতেই ছাফেলা ২য় শ্রেণি থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে লেখাপড়া করে প্রতিটি পরীক্ষা প্রথম বিভাগে ১ম স্হানে উত্তীর্ণ হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন ৷ এমনকি এদারার ৪টি জামাতের পরীক্ষায়ও প্রথম বিভাগে ১ম স্হানে বৃত্তি লাভ করতে সক্ষম হন ৷ তাঁর প্রখর মেধা স্মৃতিশক্তি এমন ছিলো যে তিনি দাওরায়ে হাদীস জামাতে ২বছর পড়াকালীন সময়ে উক্ত মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস আল্লামা বায়মপুরী রাহ. এর নির্দেশে ৩ ঘন্টা নিজে লেখাপড়া করতেন আর নিম্নের ক্নাসে ৪ঘন্টা পড়াতেন অর্থাৎ একই সাথে অধ্যয়ন করে আর শিক্ষকতা করে ও তাকমিল ফিল হাদীস শেষ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ১ম স্হান অধিকার করেন ৷ তা চারটি খানি আর কথা নয়, একই সাথে লেখাপড়া করা আর শিক্ষকতা করা সত্যিই একটি বিরল ঘটনা ৷ এমন ঘটনার নযির হাজারে দু’চারজন পাওয়া যাবে কি-না তা সন্দেহ আছে ৷ এথেকে তাঁর ছাত্রজীবনের জ্ঞানের গভীরতার পরিধি একটু সহজে অনুমান করা যায় ৷
তিনি যে সকল শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদগণের অক্লান্ত নিরলস প্রচেষ্টায় ও অকৃত্রিম ভালোবাসায় একজন শায়খুল হাদীস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত লাভ করেছেন, সে সকল শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রাহ.,আল্লামা মুজ্জাম্মিল রাহ., আল্লামা শহরুল্লাহ চটি রাহ.,আল্লামা শফিকুল হক আকুনী রাহ.শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ফয়জুল বারী মহেষপুরী রাহ.,শায়খুল হাদীস মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষিপুরী হাফিজাহুল্লাহসহ প্রমুখ মনীষীগণ ৷
কর্মজীবন : তিনি ছাত্রজীবন থেকেই কানাইঘাট মাদরাসায় এক সাথে ছাত্র ও শিক্ষকতা করে আসতেছেন ৷ ১৯৭০ সালে তাকমিল ফিল হাদীস পরীক্ষার পরই সম্পূর্ণ ভাবে শিক্ষাদানে নিয়োজিত হন ৷ কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসা তাঁর শিক্ষা ও শিক্ষকতা জীবনের প্রথম সোপান ৷
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসিন,ইলম ,আমল,তাকওয়া ও ইখলাসের পর্বততুল্য মনীষীগণ ও স্বীয় উস্তাদগণের সাথে তরুণ এ আলেমে দ্বীন দরসে নেজামির গুরুত্বপূর্ণ কঠিন থেকে কঠিনতর কিতাব সমূহ সিংহ সাবকের ন্যায় পাঠদান করান ৷
তাঁর সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের অধ্যাপনা জীবনে তিনি বহু উচ্চতর ও জটিল কিতাবাদির শিক্ষাদান করে আসতেছেন ৷ জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয়াবলী অতি সহজবোধ্য রূপে উপস্থাপন করা তাঁর শিক্ষাদানের অন্যতম বৈশিষ্ট ৷ বিশেষত তিনি তিন দশকের বেশি সময় তিরমিযী শরীফের পাঠদান দিয়েছিলেন ৷ তিরমিযি শরীফের পাঠদান ছিল তাঁর অতুলনীয় ৷ বর্তমানে তিনি মিশকাত,হেদায়া আখের ও বুখারী শরীফ প্রথমাংশের দারস প্রদান করেন ৷ যারা তাঁর কাছে পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে বা অন্যান্য মাদরাসার যেসব মেধাবী ছাত্ররা দু’চার দিন তাঁর দরসে বসেছেন ৷ তাদের ভাষ্যমতে গোটা দেশে হাতেগনা যে ক’জনের পাঠদান অত্যন্ত সুন্দন, উপস্হাপন হৃদয়গ্রাহী, সহজবোধ্য ও চিত্তাকর্ষক তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম ৷ কানাইঘাট মাদরাসা ছাড়াও তিনি মাযাহির উলুম গাছবাড়ি মাদরাসা ও মদীনাতুল উলুম খরিলহাট মাদরাসায় মাসে কয়েকদিন বুখারী শরীফ প্রথমাংশের শিক্ষা প্রদান করেন ৷
তাঁর সুদীর্ঘ পঞ্চাশ বছর অধ্যাপনা জীবনে অসংখ্য জ্ঞান পিপাসু তাঁর জ্ঞানের সাগর থেকে অমীয় সুধা পান করে নিবৃত্ত করেছেন তাদের তৃষ্ণা ৷ তাঁর ইলমী সরোবরে অবগাহন করে সিক্ত করেছেন নিজের হৃদয় মনকে ৷ তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণকারী অনেকেই আজ দ্বীন ও মিল্লাতের যোগ্য খেদমতে নিয়োজিত আছেন ৷ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন -শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা শফিকুল হক সুরইঘাটী,শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান রায়গড়ী,শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান কোম্পানিগঞ্জী রাহ. ,শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা নসিব আলী কানাইঘাটী রাহ.,শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা শামসুদ্দীন দুর্লভপুরী, বহুগ্রন্থ প্রণেতা লেখক কলামিষ্ট হযরত মাওলানা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটী রাহ.,হযরত মাওলানা আবদুর রহমান বিন মুশাহিদ রাহ., সাবেক ইমাম ও খতিব বন্দরবাজার জামে মসজিদ,শায়খুল হাদীস আতাউর রহমান কোম্পানীগঞ্জী,হযরত মাওলানা মুবাশ্বির আলী রামপ্রসাদী,হযরত মাওলানা খালেদ সায়ফুল্লাহ দুর্লভপুরী,হযরত মাওলানা শিহাবুদ্দীন বড়চতুলী প্রমুখ।
রাজনৈতিক জীবন ও বিভিন্ন দায়িত্ব পালন :
হযরত দুর্লভপুরী হাফিজাহুল্লাহ মাদরাসা শিক্ষা- দীক্ষা ওয়াজ-নসিহত এর পাশাপাশি ইসলামী রাজনীতির সাথে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন ৷ তিনি ছাত্রজীবন থেকে তাঁর প্রিয় উস্তাদ আল্লামা বায়মপুরী রাহ.এর হাত ধরে তাঁরই অনুপ্রেরণায় জমিয়তে উলামা ইসলামের সাথে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন ৷ তিনি আল্লামা বায়মপুরী রাহ.সবচেয়ে প্রিয়,বিশ্বস্ত ও সফরে হজরের একনিষ্ঠ খাদেম ছিলেন ৷ আল্লামা বায়মপুরী রাহ. তিনবার নির্বাচন করেছেন, শেষ নির্বাচন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন ৷ তাঁকে বিজয় করার জন্য তিনি জনগণের দ্বারে দ্বারে সভা-সমাবেশ ,গ্রাম-গঞ্জে ,মাঠে-ময়দানে চষে বেড়ান ৷ এবং তরুণদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি শ্রম দিয়েছিলেন তিনি তাদের একজন ৷ ১৯৯৬ সালে সিলেট ৫ আসন কানাইঘাট-জকিগঞ্জ থেকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী নির্ধারিত করার জন্য
কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসার বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলের রাতে কাইদে উলামা হযরত মাওলানা হাফেজ আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রাহ., হযরত মাওলানা শফিকুল হক আকুনী রাহ., হযরত মাওলানা আমিনুদ্দীন শায়খে কাতিয়া রাহ.,হযরত মাওলানা আবদুল্লাহ শায়খে হরিপুরী রাহ.সহ সিলেটের নেতৃস্থানীয় উলামায়ে কেরাম মাদরাসার অফিসে সমেবত হন ৷ সভায় হযরত মাওলানা ফয়জুল বারী মহেষপুরী রাহ.ও হযরত মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষিপুরীকে জমিয়তের প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য অনেক অনুরোধ ও বারবার পীড়াপীড়ি করেন ৷ এতে তাঁরা শারীরিক দুর্বলতার কারণে সম্মতি না দিলে হযরত আমিনুদ্দীন শায়খে কাতিয়া রাহ. জোরপূর্বক ভাবে হযরত দুর্লভপুরীর নাম ঘোষণা করলে সাথে সাথে আহলে মাহফিলের সবাই তাকে সমর্থন দেন ৷ নির্বাচনে প্রার্থী আর্থিকভাবে একেবারেই দুর্বল হওয়াতে তাঁর ছাত্র ভক্ত ও অনুসারীরা নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে মাত্র কয়েক দিনের মেহনতে হেভিওয়েট প্রার্থীদেরকে ভোটের লড়াইয়ে নাকানিচোবানি দিয়ে সম্মানজনক ভোট (১৪৬০০) পেয়ে তৃতীয় স্হান লাভ করেন ৷ তিনি প্রথমে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম কানাইঘাট উপজেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালান করেন ৷ হযরত মাওলানা আবদুল্লাহ শায়খে হরিপুরী রাহ.এর ইন্তেকালের পর ১৯৯৮–২০০৩ সাল পর্যন্ত ৫বছর সিলেট জেলা জমিয়তের সভাপতির দায়িত্ব কর্মতৎপরতার সাথে পালন করেন ৷ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি কাইদে উলামা খলীফায়ে মাদানী হযরত মাওলানা হাফেজ আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রাহ. তাকে খুব বেশি মহববত করতেন,যে কোনো সভা সমাবেশে পরামর্শক হিসেবে তাকে ডাকতেন ৷ এরপর তিনি রাজনৈতিক ময়দানের পিচ্ছিল পথ থেকে সরে গিয়ে ১৮-৩-২০১০সালে অরাজনৈতিক সংগঠন জমিয়তে উলামা বাংলাদেশ গঠন করে আমীরের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ৷
আজাদ দ্বীনি এদারা পূর্ব সিলেট বেসরকারি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের নাযিম বা মহাসচিবের দায়িত্বও সুষ্ঠভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন ৷ এবং মুশাহিদিয়া কিরাত প্রশিক্ষণ শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও নাদিয়াতুল কুরআন বাংলাদেশ এর সিলেট বিভাগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করে যাচ্ছেন ৷ কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসার নায়বে মুহতামিম,শায়খুল হাদীস,শিক্ষাসচিব ও খাদিজাতুল কুবরা দুর্লভপুর মহিলা মাদরামার প্রতিষ্টাতা মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বরত আছেন ৷ এছাড়া তিনি দ্বীনের বহুমুখী খেদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন ৷
আধ্যাত্মিক জীবন :
তিনি ছাত্রজীবন থেকে অত্যন্ত পরহেজগার খোদাভীরু আল্লাওয়ালা ছিলেন ৷ আত্মশুদ্ধি বা ইলমে মারেফত হাসিলের জন্য শায়খুল ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর সুযোগ্য উত্তরসূরী,আওলাদে রাসূল ফেদায়ে মিল্লাত সাইয়েদ আসআদ মাদানী রাহ. এর কাছে ১৯৭৫ সালে সিলেট নয়াসড়ক জামে মসজিদে বায়আত গ্রহণ করেন ৷ বায়আত গ্রহণের পর দীর্ঘদিন তিনি রিয়াজ ও মুজাহাদার মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতার শীর্ষ শিখরে আরোহন করলে ১৯৯১ সালে রমজান মাসে দেওবন্দে এতেকাফরত অবস্থায় স্বীয় পীর ও মুর্শিদ তাকে খিলাফত বা ইজাজত প্রদান করেন ৷ ইজাজত প্রদানের সময় ফেদায়ে মিল্লাত রাহ.বলে ছিলেন “ভাই আলিমুদ্দীন তেরে উপর বহুত মসিবত আয়েগা তুম যিয়াদা সবর করেগা ” ( ভাই আলিমুদ্দীন তোমার ওপর অনেক বালা মসিবত আসবে তুমি খুববেশি ধৈর্যধারণ করবে )৷ বাস্তবে দেখা যায় তিনি দ্বীনের উপর সীসালাঢা প্রাচীরের ন্যায় অটল অবিচল থাকার কারণে সময় অসময়ে পাহাড় সমপরিমান বালা মসিবত তাঁর ওপর আসে ৷ আল্লাহর অশেষ রহমতে তা স্রোতের পানির ওপর খড়কুটার ন্যায় ভেসে যায় ৷ তিনি খিলাফত লাভের পর আপন মুর্শিদের মত তাঁরও নিকট তাযকিয়ায়ে নাফস তথা আত্মশুদ্ধির জন্য বহুলোক বায়আত হয় ৷ তাদেরকে সারা বছর বিচ্চিন্ন ভাবে আত্মশুদ্ধির সবক দিলেও রহমত-মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মোবারকে তিনি অবিরাম ভাবে তাযকিয়ায়ে নাফসের সবক দিতে থাকেন এবং দুর্লভপুর জামে মসজিদে আলেম ওলামা ও সাধারণ মানুষের মিলন মেলা বসে ৷ একেবারে কাছে থেকে
তাঁর ইনফেরাদী আমল দেখেছি,ইজতেমায়ী আমলে অংশগ্রহণ করার সুযোগও হয়েছে অধমের ৷
জাহান্নামের ভয়ে হাউমাউ করে চিৎকার আর চিৎকার করে অঝুরে কাঁদতে দেখিনি তাঁরমত অন্যকে ৷
এ পর্যন্ত তিনি চারজনকে ইজাজত প্রদান করেন ,তাঁরা হলেন-হযরত মাওলানা মুবাশ্বির আলী রামপ্রসাদী মুহাদ্দিস দারুল উলুম কানাইঘাট মাদরাসা,হযরত মাওলানা শামসুল হক সাহেব তোয়াকুল গোয়াইনঘাট,হযরত মাওলানা হরমুজুল্লাহ সাহেব গোয়াইনঘাট শায়খুল হাদীস বাহরুল উলুম বালিঙ্গা মাদরাসা বিয়ানীবাজার,হযরত মাওলানা আবদুল কুদ্দুস সাহেব মুহতামিম মজিদিয়া জুলাই মাদরাসা কানাইঘাট ৷
পারিবারিক জীবন :
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সা. বিয়ের সঙ্গে পৃথিবীতে মানুষের বংশধারার সম্পর্ক নির্দেশ করে বলেন,
তোমরা অধিক সন্তান দানকারী স্বামী ভক্ত নারীদের বিয়ে করো ,কেননা কিয়ামতের দিন আমি তোমাদের ( সংখ্যা ) নিয়ে নবীদের সামনে গর্ব করবো ৷ ( মুসনাদে আহমদ )
হযরত দুর্লভপুরী হাফিজাহুল্লাহ পারিবারিক জীবনে শিবনগর গ্রামের মরহুম মাওলানা মুদ্দাসসির আলী রাহ. ( তিনি ১৯৭৯সালে দারুল কোরআন মঈনুল ইসলাম সেবনগর মাদরাসার প্রতিষ্ঠা করেন ) এর প্রথমা কন্যা আয়েশা বেগমের সাথে ১৯৭১ সালে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন ৷ দীর্ঘদিনের সংসার জীবন আলোকিত করে তিনি ৬ ছেলে ও ৮ কন্যাসন্তানের জনক ৷
ছেলেরা হলেন -মৌলভী আবুল খয়ের মুহিউদ্দীন,হাফেজ মুসলেহ উদ্দীন মাসরুর,হাফেজ মনজুর আহমদ,হাফেজ মাহফুজ আহমদ,মারুফ আহমদ,হাফেজ মাহমুদ আহমদ ৷
মেয়েরা হলেন-মোছা.সুরাইয়া বেগম,মোছা.সুফিয়া বেগম,মোছা.হাসনা বেগম,মোছা.শাফিয়া বেগম,মোছা.ছকিনা বেগম,মোছা.রুকিয়া বেগম,মোছা.জাকিয়া বেগম,মোছা.নাজিয়া বেগম ৷
ওয়াজ নসিহত ও খতিব পদে :
তিনি সুদীর্ঘ অর্ধশতাব্দী ধরে মাদরাসায় পাঠদান, পরিচালনার ও শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সর্ব সাধারন জনগণকে দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার মহান উদ্দেশ্যে ওয়াজ-নসিহত দাওয়াত ইরশাদের খেদমতের করে যাচ্ছেন ৷ তিনি কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইখলাস ও দরদের সাথে বয়ান করেন ৷
তাঁর ওয়াজ নসিহত ও বয়ানে বেশিরভাগ অংশজুড়ে থাকে কোনআন হাদীসের আলোকে যুক্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন কিতাবের রেফারেন্স সহকারে
তাওহিদ,রিসালত,সহীহ আকীদা ও বিভিন্ন বাতেল সম্পদায়ের মুখোশ উন্মোচন করার কথা ৷ এতে করে ছাত্র-শিক্ষক,সাধারণ জনগণ ও আধুনিক শিক্ষিতরাও তাঁর বয়ান শুনে সত্য পথের সন্ধান পান ৷ বাতিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর,হক্ব ও সত্যকথা বলতে তিনি বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি, বাতিলের রক্তচক্ষু তাকে হক্ব পথ থেকে একচুল পরিমাণও সরাতে পারেনি ৷ হক্ব ও হক্কানিয়তের ওপর তিনি সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় অটল,অবিচল এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ৷ উত্তর পূর্ব সিলেটের প্রায় মসজিদ মাদরাসার বার্ষিক সভা-সমাবেশ ও বিরাট বিরাট তাফসির মাহফিলের প্রধান অতিথি হিসেবে ঘন্টার পর ঘন্টা বয়ান পেশ করেন ৷ তাঁর বয়ানে উপকৃত হচ্ছে সর্বসাধারণ ৷
তিনি “মওদুদীবাদ ও সাহাবায়ে কেরাম” নামে একটি গ্রন্থ ও রচনা করেন ৷
তিনি দুর্লভপুর জামে মসজিদে শিক্ষকতার শুরু থেকে খতিবের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ৷ এই মসজিদের মিম্বরে বসে আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রাহ.,আল্লামা মুজ্জাম্মিল বায়মপুরী রাহ.,শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা শহরুল্লাহ চটি রাহ.,শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ফয়জুল বারী মহেষপুরী রাহ.,শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষিপুরীসহ বহু বুযুর্গাণে দ্বীন বয়ান পেশ করেছিলেন ৷ হযরত দুর্লভপুরী কোন গতানুগতিকভাবে জুম্মাবারে বয়ান দেননি ৷ খতিব জীবনের শুরু থেকে পূর্বসূরী মহামনীষীদের ন্যায় কুরআন শরীফের সূরাতুল ফাতেহা থেকে আরম্ভ করে দ্বারাবাহিক ভাবে প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামাজের পূর্বে ও রমজানে তারাবির নামাজের পর সুর্দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় তাফসির করে বিগত ২০০৮ সালে কোরআনুল কারীমের সংক্ষিপ্ত তাফসির সমাপ্ত করেন ৷ ইহা তাঁর জন্য মহান আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বিরাট বড় এক নিয়ামত ও শ্রোতাদের জন্য ছিলো উন্মুক্ত তাফসিরের পাঠশালা ৷ মূলত কেহ সারা জীবন কুরআনে কারীমের ছোট থেকে ছোট কোনো সূরা অথবা আয়াতের তাফসির করে শেষ করতে পারবে না ৷ শুধুমাত্র তিনি পূর্বসূরী আকাবিরদের অনুস্বরণ ও অনুকরণ করেছেন ৷ প্রতি শুক্রবারে তাঁর বয়ান শোনার জন্য দূরদূরান্ত থেকেও মুসল্লিগণ এসে সমবেত হন দুর্লভপুর মসজিদে ৷ সিলেট শহরের বিভিন্ন মসজিদ থেকে তাঁকে খতিব নিয়োগের অনুরোধ জানানো হলে তিনি তাঁর নিজগ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হননি,এবং গ্রামবাসিও তাকে কোথাও যেতে দেননি ৷ মূলত তিনি সূরা তাহরীম এর ৬নং আয়াতে যা বলা হয়েছে তা আমলে নিয়ে কোথায়ও যাননি ( “তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনকে আগুন হতে বাঁচা” )৷
আল্লাহর অশেষ রহমতে এপর্যন্ত তিনি ১২বার হজ্ব ও বেশ কয়েকবার উমরা ও পালন করেছেন ৷
সত্যিকারভাবে দ্বীনের উপর অটল-অবিচল থাকার চেয়ে আর কোনো বড় কারামত হতে পারে না ৷ তিনি জীবনবহর সুন্নাততো আছে মুস্তাহাবগুলোও খোঁজে খোঁজে আমল করেন এবং অপরকে ও আমলের জন্য উৎসাহিত করেন ৷
ইলম ,আমল,তাকওয়া,ইখলাস ও ধৈর্যের পর্বততুল্য এই মহামনীষী বয়স প্রায় ৭৩ এর কাছাকছি ৷ ডায়বেটিসসহ বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে আগেরমত আর চলাফেরা করতে পারেননি ৷ কায়মনোবাক্যে মহান আল্লাহর দরবারে দোআ করি তিনি যেন তাঁকে সুস্থতার সাথে নেক ও বরকতময় হায়াত দান করুন ,আমীন ৷