শায়খুল হাদীস আব্দুল হান্নান (রহ.) এর জবীন ও কর্ম
April 13 2019, 06:28
নাম :- শায়খুল হাদীস আব্দুল হান্নান (রহ.)
জন্ম / জন্মস্থান :- আব্দুল হান্নান (রহ.) হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ থানার দিনারপুর পরগনার বালিধারা গ্রামে ২৫ মার্চ ১৯৪১ সালে জন্মগ্রহন করেন।
শৈশব কাল :- ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব মেধাবী, অত্যন্ত জেদী ও দুঃসাহসী ছিলেন। মেধা বুদ্ধি ও বাল্য চঞ্চলতার কারনে তিনি ধ্বংস যাতে না হন, সে জন্য তাঁর মাতা তাকে স্বীয় পুত্র শায়েখ আব্দুল হাই দিনারপুরী (রহ.) এর হাতে সোপর্দ করে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত করার আদেশ দেন। শায়েখ আব্দুল হাই (রহ.) আপন ছোট ভাইকে আদর স্নেহে অতি যত্নের সহিত লেখাপড়া শিখাতেন। বড় ভাইয়ের নিরলস ত্যাগ ও প্রীতিময় শিক্ষা দানের প্রচেষ্টায় অল্প দিনেই তিনি কুরআন হিফজ করেন এবং উর্দূ, ফারসী, আরবী সাহিত্য সহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
শিক্ষা জীবন :- উচ্চ শিক্ষাঃ- ইসলামী জ্ঞান সাধনার প্রবল আগ্রহ নিয়ে ইলমে দ্বীনের সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সালে মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ইলমে ওহীর বিভিন্ন বিষয়ে মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে সম্মান ও খ্যাতি অর্জন করেন। উল্লেখ্য, হাটহাজারী মাদরাসার সুনামধন্য উস্তাদ মাও: হাফিজুর রহমান (রহ.) বলেন, আমার তালাবাদের মধ্যে আব্দুল হান্নান সিলেটি অধ্যয়নকালেই আমার চেয়ে বেশি বুঝেছে। মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার শতসালা সম্মেলনে আব্দুল হান্নান (রহ.) কে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দেয়া হয়।
হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষা সমাপন করে তাফসীর, হাদীস, ফিক্বাহ শাস্ত্রের অকুল পাণ্ডিত্য ও বুযুর্গানদের সান্নিধ্যে থেকে ফয়েজ ও বরকত হাসিলের জন্য করাচিতে হযরত আল্লামা ইউসূফ বিন্নুরী (রহ.) এর বিশ্ব বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন। সেখানে তিনি হাদীসের সনদ গ্রহন করেন আল্লামা ইউসূফ বিন্নুরী (রহ.), শায়খুল হাদীস রাসূল খান (রহ.), ও শায়খুল হাদীস ইদ্রিস কান্দলবী (রহ.) এর নিকট হতে।
কর্ম জীবন :- করাচিতে অধ্যয়নকালেই তাঁর ইলমে ওহীর জ্ঞানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় হযরত আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) তাকে সাক্ষাতে বলেন, আপনার শিক্ষা সমাপ্ত হলে দ্বীনের খেদমতের জন্য জামিয়া কুরআনিয়া ঢাকা লালবাগ মাদরাসায় শিক্ষকতার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি শিক্ষা সমাপনের পর কিছুদিন তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের প্রতিষ্ঠিত জামিআ’ ইসলামিয়া আরাবিয়া দিনারপুর (বালিধারা মাদরাসায়) শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৫ সালে বিখ্যাত লালবাগ মাদরাসায় আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) এর আহ্বানে সেখানে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং ফরিদপুরী (রহ.) এর সহকারী সংকলন সম্পাদনায় অংশগ্রহন করেন। এমতাবস্থায় তাঁর পান্ডিত্বের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান সাক্ষাত করে অনুরোধ করেন, আপনি সম্মত হলে প্রতিদিন গভর্ণর হাউজে তরজমাসহ কুরআন শিক্ষা দিন, আপনার আসা যাওয়ার জন্য প্রাইভেট গাড়ি থাকবে। তদুত্তরে তিনি বলেন, আপনার মোবারক আকাঙ্খা কিন্তু ইমাম বুখারী (রহ.) এর আদর্শের বিপরীত হয়, তাই সম্ভব নয়। মাদরাসায় আসলে স্বাগত জানিয়ে পড়াবো।
এরপর আল্লামা আতাহার আলী (রহ.) এর অনুরোধে সুবিখ্যাত জামিয়া এমদাদিয়া মাদরাসায় হাদীসশাস্ত্রের শিক্ষাদান আরম্ভ করেন এবং ইফতা বিভাগের দায়িত্ব গ্রহন করেন।
অতঃপর ১৯৭৩ সালে মুফতি আব্দুল হান্নান (রহ.) খ্যাতিমান কামেল বুযুর্গ আরিফ বিল্লাহ হযরত মাও: হাফেজ মোঃ আকবর আলী (রহ.) এর প্রতিষ্ঠিত জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল রহ. সিলেট -এ শায়খুল হাদীস ও নায়বে মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহন করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় অল্পদিনেই মাদরাসার সার্বিক উন্নতি সাধিত হয়। জীবনের শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্ব নিপুণ শৃঙ্খলা ও বিধিবদ্ধভাবে পরিচালনা করে গেছেন।
রাজনীতিঃ- তিনি ধর্মীয় খেদমতের সাথে সাথে সমাজসেবা ও সুনীতিকর রাজনীতির প্রবল মনোবাসনা পোষন করতেন। তাই তিনি আল্লামা আতাহার আলী (রহ.) এর পৃষ্ঠপোষকতায় নেজামে ইসলাম পার্টিতে সক্রিয় হন এবং তৎকালীন পূর্ব বাংলার নেজামে ইসলাম পার্টির সাধারন সম্পাদক ও নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালে হযরত আতাহার আলী (রহ.) এর প্রেরণায় নেজামে ইসলাম পার্টির মনোনিত প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ব্যাপক জন সমর্থন লাভ করেন।
অবদান :- সিলেটে ইসলামী আন্দোলন সমূহের রাজপথে দাবি আদায় ও প্রতিবাদের মিটিং সমাবেশের ডাক দিয়ে গড়ে তুলেন ইসলামী ইনকিলাবের সংগ্রাম।
সংকলনঃ- করাচি অধ্যয়নকালে তিনি মাসিক বায়্যিনাত পত্রিকায় মুসলিম উম্মাহর সভ্যতা ও প্রগতি কী হওয়া চাই সে বিষয়ে নিয়মিত লিখতেন। লালবাগ মাদরাসায় শিক্ষকতার সময় তিনি ফরিদপুরী (রহ.) এর সহকারী সংকলন সম্পাদনায় অংশগ্রহন করেন। আতাহার আলী (রহ.) পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতি এবং মননশীল বাংলা মুনাদী পত্রিকার সম্পাদনা করেন। তখন তিনি ইতিহাস ঐতিহ্য ও শাস্ত্রীয় চিন্তা চেতনার উপর ছোট বড় বই রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে: মুজাহিদে মিল্লাত, উলামায়ে ইসলাম কে দাওয়াতে ফিকির, বাস্তব ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্র, হযরত ইসমাঈল শহীদ (রহ.)-এর জীবনী।
মুনাজারার দক্ষতাঃ- দিনারপুর আইনগাঁও আলিয়া মাদরাসার ওযাজ মাহফিলে এক বক্তা কুরআনের আয়াত ভুল পড়ে মনগড়া তাফসীর করছিলেন। তখন মুফতি আব্দুল হান্নান (রহ.) অল্প বয়সী ছাত্র ছিলেন, তাই তিনি তাঁর ভগ্নিপতি দিনারপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের হেড মাওলানা মুফতি জহুর উদ্দীন (রহ.) কে এমন ভুল ব্যাখ্যার প্রতিবাদ করতে বলেন। কিন্তু তিনি ইতঃতস্তবোধ করলে মুফতি আব্দুল হান্নান (রহ.) নিজেই মঞ্চে আরোহণ করে মাইক হাতে নিয়ে বক্তা ও উপস্থিত সকলের সম্মুখে চ্যালেঞ্জের সহিত ভুল সংশোধন করেন।
লিখনি ও বাহাস, মুনাজারা এবং আইনী ব্যবস্থার মাধ্যমে সিলেট অঞ্চলে রেজভী ফিতনা দমন সহ বেদাআতি ফিতনা জব্দ করেন। রেজভী ও বেদাআতীরা যতবারই চ্যালেঞ্জ করেছে, প্রত্যেকবারই তাঁর নিকট পরাজয় বরন করেছে। ফলশ্রুতিতে বাতিল ফিতনাবাজরা উনার সাথে বাহাসের সাহস করতনা। কখনো কখনো বক্তদের চাপে সম্মত হলেও বাহাসস্থলে উপস্থিত হত না। ১২ ফেব্রুয়ারী ১৯৭৬ সালে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জের শিবপাশার বাহাস থেকে আলী আকবর রেজভীর পলায়নের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৬ সালে নরওয়েজীয় গীর্জার প্রেরিত খৃস্টধর্ম প্রচারক পাদ্রীর দল বাংলাদেশে এসে কলেজ ভার্সিটিতে প্রচার করতে থাকে , বর্তমান খৃস্টান ধর্ম সঠিক, ইসলাম ও মুহাম্মদ (স.) অসত্য (নাউযুবিল্লাহ)। সিলেট এম.সি কলেজে পাদ্রীদের এ মিশন প্রচার করতে আসলে কলেজের প্রফেসর প্রখ্যাত কবি আফজল চৌধুরী সাহেব তাদের সঙ্গে বাহাসের চ্যালেঞ্জ করেন। প্রফেসর আফজল সাহেব বাহাসের জন্য বিশিষ্ট আলেমগণের স্মরণাপন্ন হলে সর্বসম্মতি ক্রমে মুফতি আব্দুল হান্নান (রহ.) -কে তর্কবিদ মনোনিত করা হয়। নির্ধারিত তারিখে সরকারি নিরাপত্তায় নয়া সড়ক গীর্জায় বাহাস শুরু হয়। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত যুক্তি ও প্রামাণ্য দলিল দ্বারা ইসলামের সত্যতা ও বর্তমান খৃস্টধর্মের ভ্রান্ততা প্রমাণিত ও ঘোষিত হতে থাকে।
পাদ্রীরা লা-জাওয়াব হয়ে বাহাস মুলতবী করতঃ প্রস্তাব দেয় যে, এ বাহাস জনসম্মুখে বিশঅলাকারে অনুষ্ঠিত করার। এতে প্রফেসর আফজল সাহেব ও মুফতি আব্দুল হান্নান (রহ.) সম্মত হন। স্থান নির্ধারণ করা হয় সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ। কিন্তু পাদ্রীরা আর বাহাসে আসেনি।
হযরতের শিষ্যগণঃ- তাঁর শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, প্রখ্যাত শায়খুল হাদীস হযরত মাও: মুফতি আমিনী (রহ.) প্রিন্সিপাল লালবাগ মাদরাসা, ওলীয়ে কামেল হযরত মাও: মাহমুদুল হাসান দাঃ বাঃ, বিশিষ্ট মুনাযির হযরত মাও: সাদিকুর রহমান (রহ.) মুহাদ্দিস ও শিক্ষাসচিব মাদানিয়া বিশ্বনাথ সিলেট, হযরত মাও: আবুল কালাম যাকারিয়া (রহ.) প্রিন্সিপাল জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল (রহ.) মাদরাসা; মুহাদ্দিস আব্দুল হান্নান মাটিজুরী (রহ.)।
মৃত্যু তারিখ :- মহান এ জ্ঞানতাপস ও মহান মনীষী ২ নভেম্বর ১৯৮০ সালে পবিত্র হজ্জ পালন শেষে মক্কা শরীফে মাত্র ৪০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। বিশেষ মর্যাদায় তাঁর কফিন হাতিমে কা’বায় রাখা হয় েএবং মাকামে ইব্রাহীমে তাঁর দেহ রেখে জানাযা পড়ার পর জান্নাতুল মুয়াল্লায় উম্মাহাতুল মোমিনীন খাদিজাতুল কুবরা (রা.)- এর পাশে সমাহিত হওয়ার সৌভাগ্যবান হন।
মোবাইল :-
তথ্য দানকারীর নাম :- সৈয়দ মুনিমুল হাসান (আদিল)
তথ্য দানকারীর মোবাইল :- ০১৭৪৩০০২০৭৮