[বয়ান : ১০ যিলকদ ১৪৪০ হি. মোতাবেক ১৪ জুলাই ২০১৯ ঈ. রবিবার, সাপ্তাহিক ইছলাহী মজলিস- জামে মসজিদ, দারুল উলূম করাচী।]
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيدنا ومولانا محمد خاتم النبيين، وإمام المرسلين وقائد الغر المحجلين، وعلى آله وأصحابه أجمعين، وعلى كل من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين، أما بعد.
দীর্ঘ বিরতির পর আজ রবিবারের মজলিসে আপনাদের সাথে মোলাকাতের সুযোগ হল। ঈদের পর থেকে আমার অবিরাম সফর ছিল- বহিঃরাষ্ট্রের বিভিন্ন দেশের সফর। তাই বিগত রবিবারগুলোতে আমি উপস্থিত হতে পারিনি। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলার মেহেরবানীতে প্রতিটি সফরে বিভিন্ন রাষ্ট্রে টুকটাক খেদমত করার তাওফীক হয়েছে। তবে গতকাল (০৯ যিলকদ ১৪৪০ হিজরী, শনিবার) আমি সর্বশেষ যে সফর থেকে ফিরে এসেছি, ইচ্ছে হচ্ছে, প্রথমে এই সফরের কিছু হালত এবং কিছু উপলব্ধি আপনাদের খেদমতে পেশ করব, যাতে আমাদের সবার জন্য তা শিক্ষণীয় এবং উপকারী হয়।
এই সফরে প্রথমে আমি ইংল্যান্ড গিয়েছিলাম। আল্লাহ তাআলা সেখানে খতমে নবুওত সংক্রান্ত কিছু কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন। এরপর আরো দু’জায়গায় সফর হয়েছে- মাল্টা ও কুবরুস। উভয় স্থানে সফর করার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল।
এমনিতে তো মুসলমান পৃথিবীর সর্বত্র আবাদ রয়েছে- আলহামদু লিল্লাহ। অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেও তাদের বসতি এখন ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। মাল্টাতেও এর ব্যতিক্রম নয়। সেখানে মুসলমানগণ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বসবাস করছে। তাদের কিছু দ্বীনী জরুরত ছিল। তাই সেখানে যাওয়া তাদের জন্যও উপকারী মনে হয়েছে।
যে কারণে মাল্টা সফরে আমার আগ্রহ তবে মাল্টার প্রতি আমার আগ্রহ ও আকর্ষণের মূল কারণ অন্যটি। এই মাল্টা ঐ দ্বীপ, যেখানে আমাদের মুরব্বী হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান ছাহেব কাদ্দাসাল্লাহু তাআলা সিররাহু এবং তার শাগরেদে রশীদ শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হুসাইন আহমাদ ছাহেব মাদানী রাহ. এবং হযরত মাওলানা উযায়র গুল ছাহেব রাহ. তিন বছর বন্দী ছিলেন। মাল্টার দ্বীপটি ইটালীর নিকটে অবস্থিত। ঐ সময় সেখানে ইংরেজদের শাসন ছিল। যেভাবে ভারতবর্ষে তাদের রাজত্ব ছিল তেমনি সেখানেও তাদের রাজত্ব ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যারা তাদের বিরোধী ছিল তাদেরকে বন্দি করে রাখার জন্য এ দ্বীপটাকে নির্বাচন করা হয়েছিল। এজন্য যে, ভৌগলিকভাবে এর সাথে কোনো দেশের স্থলভাগ মিলিত ছিল না। ব্যস, কেবলই পানি বেষ্টিত একটি দ্বীপ। সেখানে তারা তাদের কয়েদীদের জন্য ক্যাম্প বানিয়ে রেখেছিল। পুরো দুনিয়া থেকে বিভিন্ন কয়েদীদের এনে তাতে বন্দী করে রাখা হত।
হযরত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান ছাহেব -কাদ্দাসাল্লাহু তাআলা সিররাহু, আল্লাহ তাআলা তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন- দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুল হাদীস ছিলেন। দারুল উলূমের সর্বপ্রথম তালিবুল ইলমও ছিলেন তিনি। আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতাআলা ইলমের সাথে সাথে যিকির ফিকির এবং তাআল্লুক মাআল্লাহর মত মহাদৌলতের উল্লেখযোগ্য হিসসা তাঁকে দান করেছিলেন। পাশাপাশি তাঁর মাঝে জিহাদের জযবাও ছিল ভরপুর। তৎকালীন বৃটিশ শাসন থেকে নিষ্কৃতিপ্রাপ্তি এবং স্বাধীনতা লাভের জন্য হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দের সেই চাটাইতে বসে এমন আলমী তাহরীক-বিশ্বব্যাপী আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন, ইতিহাস যা রেশমী রুমাল আন্দোলন নামে স্মরণ করে। বড় আশ্চর্যের বিষয় হল- তিনি তাঁর এ আন্দোলনে তিন রাষ্ট্রকে একসাথ করেছিলেন। তুর্কী, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের স্বাধীন গোত্রসমূহের যে আযাদ অঞ্চল ছিল সেগুলো। এতে তার পরিকল্পনা এমন ছিল যে, তুর্কীদের সাহায্যে হিন্দুস্তানকে বৃটিশ শাসন থেকে মুক্ত করা হবে। এ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে হযরত হজ্বে তাশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন এবং এই সফরে আনোয়ার কামাল পাশা- যিনি তুর্কী বড় জেনারেল ছিলেন, তার সাথেও মোলাকাত হয়েছিল।
তবে মিশন বাস্তবায়িত হওয়ার পূর্বেই বৃটিশদের নিকট তার কর্মপরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায় এবং তারা তাকে মক্কামুকাররমা থেকে গ্রেফতার করে ফেলে।
সেখানে হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. কিছুদিন আত্মগোপনেও ছিলেন। এভাবে নবী করীম সরওয়ারে দোআলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নতও তাঁর নসীব হয়ে যায়। যেভাবে হিজরত প্রাক্কালে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গারে ছাওরে আত্মগোপনে ছিলেন তেমনই হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-ও কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন। অবশেষে তিনি জনসম্মুখে আসেন এবং গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার সময় হযরতের উল্লেখিত বাক্যটি খুবই প্রসিদ্ধ। হযরত মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. ‘আসীরে মাল্টা’ কিতাবে তা উল্লেখও করেছেন এবং আমি শ্রদ্ধেয় আব্বাজান রাহ. থেকেও বারবার তা শুনেছি। গ্রেফতারের সময় তিনি বলেছিলেন-
الحمد للہ بمصیبتے گرفتارم نہ بمعصیتے۔
মুসীবতে আটকা আছি। কোনো মাছিয়াত বা পাপে তো আটকা নেই! তাই আল্লাহর শোকর আলহামদু লিল্লাহ।
প্রথমে তাকে মিশর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে কিছুদিন ছিলেন। পরে মাল্টায় নির্বাসিত করা হয়। সেখানে তিন বছর বন্দী জীবন অতিবাহিত করেন। এই তিন বছরের দাস্তান বড়ই আজীব এবং খুবই করুণ। এর কিছু বিবরণ হযরত মাওলানা সাইয়েদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. সফরনামা ‘আসীরে মাল্টা’য় তুলে ধরেছেন। এই কয়েদ থাকা অবস্থায় হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. কুরআনুল কারীমের তরজমা পূর্ণ করেছেন। হযরত শাইখুল হিন্দের তরজমায়ে কুরআন তো আজ বহুত মশহুর। এ তরজমায়ে শাইখুল হিন্দের সিংহভাগ হযরত ওই বন্দী অবস্থায় পূর্ণ করেছেন।
তো আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল- যে জায়গায় এ সকল মহান বুযুর্গানে দ্বীন ইসলামের জন্য এত জুলুম নির্যাতন সয়েছেন সেটা এক নজর দেখে আসি। আর একে কেন্দ্র করে যেসকল ঘটনা ও ইতিহাস বিবরিত হয়েছে- বিশেষ করে হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ ছাহেব মাদানী রাহ. যেগুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলো স্মৃতিতে নতুনভাবে জাগ্রত করি।
বহারহাল, সেখানে পৌঁছার পর দেখি এখন তা উন্মুক্ত ময়দানের মতো একটি জায়গা। হযরত মাদানী রাহ. তার সফরনামায় যে বিবরণ পেশ করেছেন সে আলোকে এটা সেই জায়গা, যেখানে তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেখানে এখন একটি স্কুল রয়েছে।
তো এপর্যায়ে আমি আমার অনুভূতি থেকে দুটি কথা আরজ করতে চাই।
প্রথম কথা : আমাদের দ্বীনী পরিবেশের কদর করি
সেখানকার মুসলমানগণ আমার আসার সংবাদ পেয়ে মুসলিম বসতিতে আমার আলোচনার প্রোগ্রাম রাখলেন। সেখানে কেউ আরব ছিল। কেউ ছিল আফ্রিকান। কিছু লিবিয়ান মুসলিমও ছিলেন। হরেক ভাষার মুসলমানের মজমা ছিল। সেখানে আমার নিকট এমন কোনো বিশেষ ভাষা ছিল না, যে ভাষাতে তাদের সাথে কথা বলব। এজন্য ইংরেজীতেই তাদের সাথে আলোচনা হয়।
আল্লাহ তাআলা সেখানে এমন এক ইন্তেযাম করে দিলেন যে, সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। এই কিছুদিন হল তিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন। আমার আসার সংবাদ পেয়ে তিনি সেখানকার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। তিনি নিজেই হোটেলে আমার সাথে দেখা করতে আসেন। তার সাথে কিছু আলোচনা করার সুযোগ হল। পুরো মাল্টা দ্বীপে এখনো কোনো নিয়মতান্ত্রিক মসজিদ নেই। মুসলামানগণ বিভিন্ন স্থানে নামাযের জন্য ব্যবস্থা রেখেছে। বহু দূর দূর এলাকা পার হওয়ার পর কোথাও কোথাও নামাযের ইন্তেযাম পাওয়া যায়। আপাতত তারা সরকারের পক্ষ থেকে কর্জ হিসেবে একটা হল পেয়েছে। সে হলে আমার আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক মসজিদ বানানোর অনুমতি এখনো তারা লাভ করেনি।
তো আমি তার নিকট আবেদন করলাম- দেখুন, এখানে তো মুসলমানগণ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বসবাস করছে। তাদেরকে অন্তত মসজিদ বানানোর অনুমতি দেওয়া হোক এবং তাদের জন্য এরকম মসজিদের ব্যবস্থা করা হোক যেখানে তারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও পড়তে পারবে এবং জুমআও পড়তে পারবে। সরকার পক্ষ আমার নিকট এক রকম ওয়াদাই করল। আশা করি দ্রুত একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে- ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু এখানে আমাদের জন্য লক্ষণীয় বিষয় হল- সেখানে মুসলমানগণ সংখ্যায় লঘিষ্ঠ। তাদেরকে দ্বীন শেখানোর মতো কেউ নেই। দ্বীন পড়ানোর কেউ নেই। আর যাদের দিলে কিছু দরদ-তড়প রয়েছে তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ফিরে- কখনো অনলাইনের মাধ্যমে, কখনো অন্য কোনো মাধ্যমে কুরআনে কারীম শেখে। নিয়মতান্ত্রিক কোনো মকতবও নেই যে, তাতে বাচ্চাদেরকে কুরআনে কারীম পড়ানো হবে।
তো সেখানকার মুসলমানদের সাথে আলোচনা করে এই চেষ্টা করা হয়েছে যে, যেখানে যেখানে নামাযের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে যেন মক্তবও কায়েম করা হয়। অন্যথায় মুসলমানদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নষ্ট ও বিপথগামী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের জন্য যে বিষয়টি ইবরত বা উপদেশমূলক তা হল- সেখানে মসজিদ না থাকা সত্ত্বেও যারা মুসলিম হিসেবে জীবনযাপন করতে চায় তারা অত্যন্ত কষ্ট ও কুরবানী করে দ্বীনের উপর কায়েম রয়েছে এবং দ্বীনদারী রক্ষায় চেষ্টা ও মুজাহাদা করে যাচ্ছে। আমার এই ইবরত হয়- আল্লাহ তাআলা আমাদের দেশে সর্বধরনের দ্বীনী আযাদী রেখেছেন। নামায পড়ায় কোনো বাধা নেই। মসজিদ প্রতিষ্ঠায় কোনো পাবন্দি নেই। মাদারিস-মাকাতিব রয়েছে প্রচুর। উলামায়ে কেরামও রয়েছেন- আলহামদু লিল্লাহ। এরপরও দ্বীনের সেই জযবা ও সেই শওক, যা ঐ সকল লোকদের মাঝে রয়েছে, যারা মাইলকে মাইল সফর করে কোথাও গিয়ে তবে জামাতের সাথে নামায পড়তে পারে, সেই শওক ও জযবা আমাদের এখানে কোথায়! এখানে তো আল্লাহর মেহেরবানীতে মসজিদগুলো উন্মুক্ত থাকে। যে যেখানে ইচ্ছা গিয়ে জামাতে শরীক হতে পারছে। তবুও এখানে নামাযে কোতাহী হয়, জামাতে অবহেলা হয়। তাই চিন্তা করা উচিত- আল্লাহ তাআলা যেসকল নিআমত দিয়ে রেখেছেন সেগুলো আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না। ঐ সব ভাইদের হালত থেকে ইবরত হাছিল করুন, যাদের নিকট আজ আমাদের মতো দ্বীনী উপায়-উপকরণ এবং ধর্মীয় সুযোগ-সুবিধা নেই। এ হল আমার প্রথম কথা।
দ্বিতীয় কথা : মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ
আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী ছাহেব কাদ্দাসাল্লাহু তাআলা সিররাহু, যিনি এই দারুল উলূমের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তাঁর থেকে আমি বার বার একথা শুনেছি যে, ছাত্রাবস্থায় আব্বাজানের মামুল বা রুটিন এরকম ছিল- আছরের পর যখন তালিবে ইলমদের খেলার সময় বা অবকাশ-বিনোদনের বিরতি থাকত তখন হযরত ওয়ালেদ ছাহেব রাহ. খেলাধুলা কিংবা অন্য কোনো তাফরীহে যাওয়ার পরিবর্তে হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর মজলিসে হাজির হতেন।
হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর মামুল ছিল তিনি আছরের পর দারুল উলূমের নির্দিষ্ট একটি গাছের নীচে বসতেন। আসাতেযা-তলাবা যারা যারা চাইত হযরতের এখানে চলে আসত। এভাবে গাছের নীচেই হযরতের মজলিস কায়েম হয়ে যেত। হযরত রাহ. কখনও এই কথা কখনও সেই কথা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। আব্বাজান রাহ. আছরের পরের বিরতির সময়টা হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর এ মজলিসেই কাটাতেন।
হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর প্রতি আব্বাজানের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মহব্বত-ভালোবাসার সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল যে, আব্বাজানের ইচ্ছা ছিল, দাওরায়ে হাদীস হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর কাছেই পড়বেন। কিন্তু তাকদীর- আব্বাজানের দাওরায়ে হাদীসের বছর হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. মাল্টায় বন্দী। আব্বাজান রাহ. ঐ বছর দাওরা না পড়ে এক বছর মুলতবী করলেন। এসময় তিনি ফুনূন ইত্যাদির কিছু কিতাবাদি মুতালাআ করেছেন। এগুলো পড়তে পড়তে হয়ত আগামী বছর হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. তাশরীফ নিয়ে আসবেন- এ আশায়। কিন্তু এর পরের বছরও যখন হযরত মুক্তি পেলেন না তখন আব্বাজান রাহ. হযরত মাওলানা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ.-এর নিকট দাওরায়ে হাদীসের কিতাব বুখারী শরীফ পড়েন।
আব্বাজান আমাদেরকে হযরত শাইখুল হিন্দের ঐ মজলিসের অনেক কথা শোনাতেন। তিনি বলতেন- হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. মাল্টা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দেওবন্দ ফিরে এসে ঐ গাছের নীচেই মজলিস করতেন। মুক্তির পর একদিন ঐ গাছের নীচে মজলিস করছিলেন, ঐ সময় একটা কথা বললেন, বড় দামী সে কথা। তিনি বললেন, মাল্টার বন্দী জীবনের একাকিত্বে খুব চিন্তা ফিকিরের পর আমার মনে হল- মুসলমানদের অধঃপতনের মৌলিক কারণ দুটি।
আপনি চিন্তা করে দেখুন, শাইখুল হিন্দের মত এত বড় ব্যক্তিত্ব, যার পুরোটা জীবন কেটেছে কুরআন-হাদীস নিয়ে। যিনি আল্লাহর রাস্তায় এত এত কুরবানী স্বীকার করেছেন। জীবনে কত চড়াই উৎরাই পার করেছেন! শীত-গরম, খরা-বর্ষা এবং হেমন্ত-বসন্তের কত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন! আল্লাহর রাস্তায় এতটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছেন! পুরো বিশে^র হালত পর্যবেক্ষণ করেছেন। এরপর বলছেন, আমি মাল্টার বন্দী জীবনের একাকিত্বে খুব চিন্তা-ভাবনা করার পর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ দুটি।
প্রথম কারণ : কুরআনে কারীম ছেড়ে দেওয়া
উম্মতে মুসলিমা কুরআনুল কারীমকে পিছে ঠেলে দিয়েছে। কুরআনুল কারীম ছেড়ে দিয়েছে। কুরআন কারীম ছেড়ে দিয়েছে মানে- (ক) তার তিলাওয়াত ছেড়ে দিয়েছে- যেভাবে তিলাওয়াত করা উচিত ছিল। (খ) এর অর্থ বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে এবং (গ) এতে যেই তালীম ও শিক্ষা রয়েছে তার উপর আমল করা ছেড়ে দিয়েছে। কুরআন ছেড়ে দেওয়ার মাঝে এই তিন অর্থ নিহিত রয়েছে।
কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত একটি স্বতন্ত্র আমল
কুরআনুল কারীমের হুকূক আদায়ের সর্বপ্রথম সিঁড়ি হচ্ছে কুরআনে কারীমের তিলাওয়াত। অর্থাৎ মুসলমান এর তিলাওয়াত করবে। যদিও কুরআনুল কারীম অবতরণের মূল উদ্দেশ্য হল- কুরআনুল কারীমের মাঝে যে তালীমাত রয়েছে সেগুলো আমলে নিয়ে আসা। কিন্তু এর প্রথম ধাপ হচ্ছে তিলাওয়াত। তিলাওয়াতে কুরআন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এমন মহান এক নুসখা যে, কুরআনে কারীমের শুধু তিলাওয়াতটিই একটি স্বতন্ত্র ইবাদত এবং বড় সৌভাগ্যের বিষয়। হাদীসে বলা হয়েছে- কুরআন কারীম তিলাওয়াত করলে প্রতিটি অক্ষরে দশ দশ করে নেকী পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ব্যাখ্যা করে বলেন, আমি একথা বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি স্বতন্ত্র হরফ এবং লাম একটি স্বতন্ত্র হরফ এবং মীম একটি স্বতন্ত্র হরফ- তো শুধু আলিফ-লাম-মীম তিলাওয়াত করার মাধ্যমে ত্রিশ নেকী অর্জিত হয়ে যায়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন নুসখায়ে শেফা- যা মূলত হেদায়েতের নুসখা- দান করেছেন, যার কোনো তুলনা হয় না। ডাক্তারের নুসখা তো এমন হয় যে, ডাক্তার বলে দেন- এটা হল তোমার ব্যবস্থাপত্র। এ অনুযায়ী তুমি ওষুধ সংগ্রহ করে ব্যবহার করবে। কিন্তু এখন যদি তুমি সেই প্রেসক্রিপশন সারা দিন পড়তে থাক, তাহলে এতে কোনো ফায়েদা নেই। তোমার রোগ এতটুকুও ভালো হবে না। কিন্তু এই নুসখায়ে শেফা এতটাই মুফীদ ও উপকারী যে, এর উপর আমল করা এবং এর অর্থ-মর্ম অনুধাবন করা যদিও একেকটি স্বতন্ত্র আমল এবং বড় বড় আমল। তবে এগুলোর সাথে সাথে শুধু এর তিলাওয়াটাই একটি স্বতন্ত্র আমল।
এজন্য মুসলিম সমাজের একটা ঐতিহ্য এও ছিল যে, দৈনিক কিছু না কিছু তিলাওয়াত করা ব্যতীত পুরোটা দিন কাটিয়ে দিবে- এমন মুসলমান পাওয়া যেত না। সাধারণত ফজরের পর মুসলিম ঘরগুলো থেকে তিলাওয়াতের ধ্বনি ভেসে আসত। মুসলিম সমাজের এটা একটা বড় ইমতিয়ায ও বৈশিষ্ট্য ছিল। মুসলিম বসতিতে গেলে মানুষ বুঝে ফেলত যে, এটা মুসলিম জনপদ এবং এখানকার ঘরগুলো তিলাওয়াতে কুরআনে মুখরিত হয়ে আছে।
তো হযরত রাহ. বলেন- মুসলমান এই আমল ছেড়ে দিয়েছে। দৈনিক কিছু হলেও তিলাওয়াত করার যে রুটিন মুসলিম জীবনে ছিল, অনেকেই বরং বলা যায় অধিকাংশ মুসলিমই তা ছেড়ে দিয়েছে।
তিলাওয়াত ছেড়ে দেওয়ার একটা বড় কারণ এও যে, অনেক মুসলমান তিলাওয়াতটাই শিখেনি। বড় বড় পদ ও পদবীর অধিকারী হয়ে গেছে। বড় লিডার বনে গেছে। আমীর হয়ে গেছে। সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তি হয়ে গেছে। এতকিছু হয়ে গেছে, কিন্তু মুসলমান কুরআন শরীফ স্বাভাবিকভাবে পড়তে শেখেনি। তাহলে তিলাওয়াত করবে কীভাবে?! বহুত আফসোসের কথা!!
একটি ভুল ধারণা
সমাজে একটি মারাত্মক ভুল ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়- ভাই, কুরআন তো এজন্য এসেছে যে, তুমি এটা বুঝবে এবং এর উপর আমল করবে। শুধু তিলাওয়াতে কী ফায়দা? এটা মস্ত বড় ভুল ধারণা।
আমি তো মাত্রই রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শোনালাম- কুরআন তিলাওয়াত করলে প্রতিটি হরফে দশটি করে নেকী হাছিল হয়। আর যে ব্যক্তি তিলাওয়াতই জানে না, তিলাওয়াত করার অভ্যাসই যার নেই, সে এর উপর কী আমল করবে! কুরআনের কাছে আসার প্রথম ধাপই তো হল তিলাওয়াতে কুরআন।
তো হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. -আল্লাহ তাআলা তাঁর মরতবা বুলন্দ করুন- বলেছেন, এই কুরআনকে ছেড়ে দেওয়া- অর্থাৎ ক. তিলাওয়াত ছেড়ে দেওয়া, খ. এর অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করা ছেড়ে দেওয়া এবং গ. এর শিক্ষা অনুসারে আমল ছেড়ে দেওয়া- এগুলো মুসলমানদের অধঃপতনের একটা মৌলিক কারণ।
হযরত বলেন- এজন্য আমি আমার বাকি জীবন এই কুরআনের খেদমতেই ব্যয় করব, ইনশাআল্লাহ। অর্থাৎ কুরআনে কারীমের তালীম আম ও ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করব। এ কল্পে হযরত পুরো হিন্দুস্তানজুড়ে মক্তব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অনেক মক্তব প্রতিষ্ঠাও করেন, যাতে সবাই দ্বীন শিখতে পারে।
বর্তমান সময়ে মুসলমানদের হালচাল
এখন আমরা এ বিবেচনায় নিজেদের অবস্থার দিকে একটু নজর দেই- মুসলমানদের ধ্বস কোনো নির্দিষ্ট ভূখ-ের ধ্বস নয়। নির্দিষ্ট কোনো রাজত্বের পতন নয়। পুরো মুসলিম বিশে^র অধঃপতনের চিত্র তো আপনারা নিজ চোখেই দেখতে পাচ্ছেন- মুসলিম উম্মাহ কোন্ শিখর থেকে কোন্ অতলে চলে এসেছে। এক সময় তো ইসলামী শক্তির এরকম হালত ছিল যে, মুসলিম রাজত্বে সূর্য ডুবত না। ইন্দোনেশিয়া থেকে মারাকেশ পর্যন্ত পুরো এলাকাজুড়ে মুসলিম রাজত্ব ছিল এবং এই পুরো অঞ্চলে মাত্র একজন খলীফা ছিলেন- উসমানী সালতানাতের খলীফা। সকলে তার অধীনে কাজ করত। তার তত্ত্বাবধানেই কুরআনে কারীমের তালীম হত, হাদীসের তালীম হত, ফিকহের তালীম হত। এছাড়া আরো যত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শাস্ত্র-বিদ্যা রয়েছে, সবকিছু শেখার ব্যবস্থা ছিল। বড় বড় আহলে ইলম ও বিজ্ঞানী সেখান থেকে তৈরি হতেন এবং সকলেই হতেন মুসলমান। হাঁ, চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, রুচি-প্রকৃতি সার্বিকভাবেই তারা মুসলিম হতেন।
কিন্তু এখন বলুন- মুসলমানের কী অবস্থা! বাহ্যিকভাবে ভারতবর্ষে বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটেছে। কিন্তু মুসলমানরা বৃটিশদের মানসিক দাসত্ব থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। চিন্তা-চেতনায় এখনও তাদের গোলাম হয়ে আছে। তাদের রঙঢঙ, চলাফেরা, জীবনাচার, সভ্যতা-সংস্কৃতি গ্রহণ করাকে নিজেদের জন্য সম্মান ও সৌভাগ্যের কিছু মনে করছে। এভাবে চলতে চলতে তারা ক্ষমতায়ও চলে আসছে। কিন্তু যখন কুলহুয়াল্লাহ জিজ্ঞাসা করা হয় তখন তাদের পক্ষে আর তিলাওয়াত করা সম্ভব হয় না।
মোটকথা, অধঃপতনের মূল কারণ হচ্ছে কুরআন ছেড়ে দেওয়া।
আর যারা তিলাওয়াত করে থাকেন, চিন্তা করে দেখুন, তাদের ক’জন এমন রয়েছেন, যারা তিলাওয়াতের পাশাপাশি এর তরজমা-তাফসীরসহ অর্থ মর্ম বুঝে বুঝে পড়েছেন। ভাই, কুরআন কারীম আল্লাহ তাআলার পয়গাম নিয়ে এসেছে। আমরা আল্লাহ তাআলার বান্দা। একটু তো বুঝার চেষ্টা করি- এতে রয়েছে কী! আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য কী পয়গাম পাঠিয়েছেন?
মনে করুন, আপনার নিকট আপনার এক প্রিয় বন্ধু এবং যার বন্ধুত্ব আপনার নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ- এমন প্রিয় বন্ধুর পক্ষ থেকে যদি আপনার নিকট ভিন ভাষায় কোনো পত্র আসে- এমন ভাষা যা আপনি জানেন না। কথার কথা ইংরেজিতে আসল, আর আপনি ইংরেজি জানেন না। কিংবা আরবীতে আসল, অথচ আপনার আরবী জানা নেই। তো এমন পত্র আসলে কি আপনি তা না বুঝে সযতেœ আলমারীতে রেখে দেবেন! অথচ আপনি জানেন আমার গুরুত্বপূর্ণ একজন আন্তরিক বন্ধু আমার নিকট পত্র মারফত কোনো জরুরি বিষয়ে অবগত করেছে। নাকি যেভাবেই হোক সেই পত্রের ভাষা আপনি উদ্ঘাটন করেই ক্ষান্ত হবেন- আপনার প্রতি সে কী বার্তা পাঠিয়েছে। কারো মাধ্যমে তরজমা করিয়ে নিবেন কিংবা যে বুঝে তার থেকে বুঝে নিবেন; তাই না!
কিন্তু কুরআনে কারীম, যা গোটা উম্মতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে পয়গাম। যাতে হেদায়েতের সকল তালীম রয়েছে। সেই কুরআনে কারীম সারা জীবন আলমারীতেই থেকে যাবে। তা খুলে তিলাওয়াতও করা হবে না এবং এর অর্থ মর্ম অনুধাবনের তাওফীকও হাছিল হবে না! বলুন এর চেয়ে ক্ষতি ও দুর্গতি আর কী হতে পারে!
তো এ থেকে সবক পাওয়া যায় যে, কুরআনে কারীম তিলাওয়াতও করতে হবে এবং তিলাওয়াতের সাথে সাথে মুসলমান দৈনিক কিছু সময় এর অর্থ মর্ম বোঝার জন্য বরাদ্দ রাখবে। সে জানতে চেষ্টা করবে- আল্লাহ তাআলা তার কাছে কী পয়গাম পাঠিয়েছেন এবং সেই তালীম অনুযায়ী সে আমল করতে থাকবে।
তো হযরত বলেন- মুসলমানদের অধঃপতনের একটা বড় কারণ হল, কুরআনে কারীম ছেড়ে দেওয়া।
দ্বিতীয় কারণ : পারস্পরিক বিভক্তি
হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. মুসলমানদের অধঃপতনের দ্বিতীয় মৌলিক কারণ হিসেবে যেটি চিহ্নিত করেছেন, তা হল মুসলমানদের পারস্পরিক বিভক্তি ও ফেরকাবন্দী। অর্থাৎ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ে গ্রুপিং করা। মামুলি বিষয় নিয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়া।
মুসলমান এখন যেনতেন বিষয়ে দল উপদলে বিভক্ত হয়ে আছে। ফেরকাবন্দী এবং মতবিরোধের বাজার এখন খুব চাঙা। সবাই এটা মনে করে যে, একমাত্র আমিই সঠিক আর বাকি সবাই ভুল এবং সর্ববিবেচনায় ভুল। অতএব যখন সে ভুল তাই তার সাথে উঠাবসা, চলাফেরা, কথাবার্তা কোনো কিছুই আর চলবে না। কোনো ধরনের কোনো সম্পর্ক আর রাখা যাবে না।
মাসলাক ও মতাদর্শে ভিন্নতা থাকতে পারে। মতাদর্শের ভিন্নতার মাঝেও তো বিভিন্ন স্তর-পর্যায় রয়েছে। কারো কারো সাথে শাখাগত বিষয়ে বিভেদ থাকে। অর্থাৎ এই এতটুকুতে আমাদের মাসলাকী ইখতেলাফ। কিন্তু আমরা আমাদের সর্বশক্তি এবং চূড়ান্ত প্রতিভা শুধু এতেই অপচয় করি যে, কীভাবে অন্যের পুরো মতটাকে ভ্রান্ত ও বাতিল আখ্যা দেওয়া যায়।
গোটা উম্মতে মুসলিমা সামগ্রিকভাবে যে সকল জটিল ও কঠিন সমস্যায় জর্জরিত সেগুলো নিয়ে কখনও ভাবি না। কুফর ও ইলহাদের প্রবল ঝঞ্ঝা, যা গোটা বিশ্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। যেখানে যেখানে মুসলিম আবাদী রয়েছে সেখানে তারা কতটা জাহালাতের শিকার হয়ে আছে! মুসলমানদের উপর কুফরী শক্তি কীভাবে চেপে আছে! কিন্তু সে সকল জটিল জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য এরা পরস্পরে বসতে প্রস্তুত নয়।
এই দলবিভক্তি ও ফেরকাবন্দী এবং গ্রুপিং করতে করতে তো এখন অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, আগে তো আদর্শে আদর্শে দ্বন্দ্ব ছিল। কিন্তু এখন একই আদর্শে পরিচালিত গ্রুপের মাঝে শুধু দল বাড়ছেই। অর্থাৎ বিভক্তি তাতে আবার বিভক্তি আবার তাতে বিভক্তি- এভাবে শুধু বিভক্ত হচ্ছেই। এ একদলের সে আরেক দলের। অথচ উভয়ের মতাদর্শ ও মতবাদ এক। কিন্তু দুজন যে একসাথে মিলে বসবে এ পরিস্থিতিটুকু নেই। এ ওকে খারাপ বলে, ও একে খারাপ বলে। এভাবে শুধু বিভক্তি আর বিভক্তি চলছেই।
আমাদের এই বিভক্তি থেকে এখন দুশমনরা ফায়দা নিচ্ছে। এর ফলে মুসলমানগণ আরো অধঃপতনের স্বীকার হচ্ছে। যখনই মুসলমানদের মাঝে বিভক্তি ও ফাটল দেখা দিয়েছে তখনই দুশমনরা এর থেকে সর্বোচ্চ লাভবান হতে চেষ্টা করেছে। দুশমনরা কখনও সম্মুখ সমরে মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি। যদ্দুর পরাজিত করেছে তা বিভক্তি ও ফাটল সৃষ্টি করার মাধ্যমে করেছে। আমাদের নিজেদের মাঝে গাদ্দার মুনাফেকদের মাধ্যমে করেছে। এবং মুসলিম উম্মাহকে টুকরো টুকরো করার মাধ্যমে মুসলমানদেরকে পরাস্ত করেছে ।
আমি যে আপনাদেরকে বলছিলাম- খেলাফতে উসমানিয়া পুরো পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি অঞ্চলজুড়ে শাসন করছিল। এই খেলাফতকে ধ্বংস করা হয়েছে এই বিভক্তির মাধ্যমে। তারা আরবদের এই ধোঁয়া দিল যে, তোমরা হলে আরব, তুর্কীদের সাথে তোমাদের থাকা উচিত নয়। আর তুর্কীদের বলল- তোমরা তো তুর্কী, কেন তোমরা আরবী ভাষা রেখেছ? এভাবে বিভক্তি সৃষ্টি করে খেলাফতকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। তো এভাবে উম্মত বিভক্ত হতে থাকে আর তাদের শক্তি খর্ব হতে থাকে।
হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ. বলেন- ইনশাআল্লাহ, এখন থেকে আমি সাধ্যমত চেষ্টা করে যাব যাতে উম্মতের মাঝে এই বিভক্তি যত কম থেকে কম হয়।
হযরত তার বাকি জীবন এর সুরাহায় প্রচেষ্টা অব্যাহতও রেখেছিলেন। কিন্তু হযরত ছিলেন পড়ন্ত বেলায় উপনীত। কিছুদিন পর হযরত দুনিয়া থেকে তাশরীফ নিয়ে যান।
মতভিন্নতাকে তার গণ্ডির ভেতর রাখুন
মনে রাখার বিষয় হল- ইখতেলাফের এবং মতভিন্নতারও বিভিন্ন পর্যায় ও স্তর থাকে।
এক. ঈমান-কুফরের ইখতেলাফ। এক্ষেত্রে কোনো আপসরফা নেই। ঈমান-কুফরের মাসআলায় কারো সাথে কোনো সমঝোতা নেই। যেমন, কাদিয়ানীরা রয়েছে। মুনকিরীনে হাদীস (হাদীস অস্বীকারকারীরা) রয়েছে। তাদের সাথে আদর্শগত এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত কোনো আপস এবং সমঝোতা নেই।
হাঁ, তাদেরকে দাওয়াত দিতে হবে। দাওয়াত দিতে হবে নববী তরীকায়। আম্বিয়ায়ে কেরাম কখনও গালি দিতেন না। এমনকি গালির জবাবেও না। আম্বিয়ায়ে কেরাম সর্বদা মহব্বত ও ভালোবাসার সাথে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দিতেন।
এটা আমাদের জন্য অনেক বড় সবক যে, যারা ইসলামের গণ্ডি বহির্ভূত তাদেরকেও দাওয়াত দেওয়ার সময় নববী উসূল ও তরীকা গ্রহণ করতে হবে।
اُدْعُ اِلٰی سَبِیْلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَ الْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَ جَادِلْهُمْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ .
অর্থাৎ দাওয়াত দিতে গিয়ে যদি বিতর্কের অবস্থা সৃষ্টি হয় তাহলে তার মোকাবেলা করো উত্তম পন্থায়। গালি দিয়ে নয়। তাদেরকে গালমন্দ করে নয়। বরং ভালবাসার সাথে। যে ব্যক্তি কুফরে লিপ্ত তাকে দেখে ক্ষিপ্ত হবার নয় বরং ভীত হবার বিষয়। কারণ এ ব্যক্তি তো তার ভুল আকীদার কারণে জাহান্নামে জ¦লবে।
তো এটা হল কুফর ও ইসলামের এখতেলাফ।
দুই. আরেক ধরনের ইখতেলাফ হল, হক-বাতিলের ইখতেলাফ। কুফর ও ইসলামের ইখতেলাফ নয়। অর্থাৎ সে ইসলামের চৌহদ্দিতেই রয়েছে। তবে কিছু বাতিল ও ভ্রান্ত বিষয়ে লিপ্ত রয়েছে। তো এর সাথে মুআমালা ও আচরণ হবে ভিন্ন রকম। দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে তার খ-ন ও প্রতিবাদ হবে। কিন্তু তার উপর বাড়াবাড়ি ও যুলুম করার কোনো সুযোগ নেই।
তিন. তৃতীয় আরেক ধরনের ইখতেলাফ হয় মতভিন্নতা বা মাযহাবগত ইখতেলাফ। হানাফী শাফেয়ী মালেকী হাম্বলী- এগুলো হল একেকটি মাযহাব। এগুলো সবগুলোই হক, কোনোটিই বাতিল ও ভ্রান্ত নয়। এজন্য তাদের উপর আপত্তি তোলাও জায়েয নেই। যেমন কোনো গায়রে শাফেয়ী ব্যক্তি যদি শাফেয়ী কোনো মুুসল্লীর উপর আপত্তি তুলে যে, ভাই, তুমি নামাযে কেন হাত উঠাও? কেন জোরে আমীন বল? তাহলে এভাবে তার উপর আপত্তি তোলা জায়েয হবে না। কেননা এগুলো হল মুজতাহাদ ফীহ মাসআলা। এতে কোনো মতই ভ্রান্ত বা বাতিল নয়। উভয় পদ্ধতিই সঠিক। তো এটা হল মাযহাবের এখতেলাফ।
যেখানে বিদআতের প্রচলন রয়েছে সেখানে মহব্বত, ভালবাসা এবং সম্প্রীতির মাধ্যমে ভদ্রতা ও শারাফত বজায় রেখে তাদের রদ করা চাই। কিন্তু মুজতাহাদ ফীহ মাসআলার ক্ষেত্রে যদি সুন্নত-বিদআতের ইখতেলাফের মতো আচরণ হয় যে, আমরা তাদের সাথে চলতে পারছি না, বসতে পারছি না তাহলে এটা অনেক খারাপ কথা। দ্বীনের তাকাযা ও মেযাজ এরকম নয়। যদি এমন হয় তাহলে তা হবে ফেরকাবন্দী এবং দলবাজী। তাই এ ধরনের আচরণ থেকে বেঁচে থাকা খুবই জরুরি।
হযরতের এ নসীহত এতটাই অমূল্য রতন যে, স্বর্ণাক্ষরে তা লিখে রাখা উচিত। আমাদের অধঃপতনের দুটি কারণ- ক. কুরআন ছেড়ে দেওয়া। খ. ফেরকাবাজি করা, পরস্পরে বিভক্ত হয়ে পড়া।
আল্লাহ তাআলা আপন ফযল ও করমে আমাদেরকে হযরতের কথার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমরা যেন কুরআনে কারীমকে প্রকৃত অর্থেই সীনায় লাগাতে পারি। দিল দিয়ে তা উপলদ্ধি করতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তা বুঝবার তাওফীক দান করুন। যারা নিয়মতান্ত্রিক আলেম নই তারা অন্তত দিনের ২৪ ঘণ্টা থেকে অল্প কিছু সময় বের করে নেব এর তরজমা-তাফসীর পড়ার জন্য। উলামায়ে কেরাম অত্যন্ত সহজ, সরল ও সাবলীলভাবে সাধারণ বোধগম্য করে কুরআনে কারীমের তরজমা তাফসীর করেছেন। এরকম তাফসীর অনেক। সাবলীল তাফসীরও রয়েছে, উচ্চাঙ্গের তাফসীরও রয়েছে। স্বংক্ষিপ্ত তাফসীরও রয়েছে, বিস্তারিত তাফসীরও রয়েছে। সব ধরনের তাফসীর রয়েছে। কিন্তু বন্ধু, এগুলো থেকে ফায়দা তো গ্রহণ করতে হবে! তাই নারী-পুরুষ সকলে যদি এভাবে রুটিন করে নিই যে, প্রতিদিন অল্প সময়, পনের মিনিটই হোক, কুরআনে কারীম তরজমা-তাফসীরসহ পড়ব। (সাধারণ পাঠকের জন্য উপযোগী তাফসীরের মাঝে তাফসীরে ইবনে কাসীর, তাফসীরে মাআরেফুল কুরআন, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, তাফসীরে উসমানী, তাফসীরে আশরাফী উল্লেখযোগ্য।)
তাফসীরসহ এজন্য পড়তে বলছি যে, অনেক সময় শুধু তরজমা পড়লে ভুল মর্ম বুঝে থাকে। এজন্য তাফসীরের সাথে পড়া চাই। তো এভাবে পড়লে ইনশাআল্লাহ অনেক ফায়দা হবে এবং কুরআনে কারীম ছেড়ে দেওয়ার কারণে আমাদের আজ যে বিপর্যয় তা অনেকাংশে দূর হবে- ইনশাআল্লাহ।
তো আমি মাল্টার সফরের কিছু অনুভব-অনুভূতি আপনাদের সামনে পেশ করলাম। আল্লাহ তাআলা এর ভালো দিকগুলোর উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। হ
[তরজমা : আশিক বিল্লাহ তানভীর]