বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বেফাকুল মাদারিস’র (কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড) এর সাবেক সহ-সভাপতি ও আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম বাংলাদেশ সভাপতি গোলাপগঞ্জের ঢাকাউত্তর রানাপিং আরাবিয়া হুসাইনিয়া মাদরাসার সরপরস্ত ও শাইখুল হাদীস আল্লামা ওবায়দুল হক রাহ. উজিরপুরী এদেশের মুসলিম মনীষীদের মধ্যে অতুলনীয় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, মুফাসসির, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও পার্লামেন্টারিয়ান। আমাদের জাতীয় ও সমাজ জীবনে তাঁর রয়েছে বহুমুখী ও বিশাল অবদান। কুরআন, হাদিস, ফেক্বাহ, আরবী ও উর্দু সাহিত্য, ইসলামি শিক্ষা বিস্তার ও পার্লামেন্টারিয়ান সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর জ্ঞান চর্চা কেন্দ্রীভূত ছিল ইসলামী দর্শনভিত্তিক সর্বস্তরে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, যা সাধারণ মানুষের চিন্তার ও মুক্তির বার্তারুপে গৃহীত হয়েছে।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে এদেশে বিশুদ্ধ ইসলামি জ্ঞান চর্চার পথ সুগম ছিল না। পরাধীনতা তখন নানাভাবে মুসলমানদের উন্নয়ন ও অগ্রযাএার পথে প্রতিবন্ধক হয়েছিল। ব্রিটিশের আগ্রাসী তৎপরতায় উপমহাদেশের মুসলিম ঐতিহ্য, ইসলামী সংস্কৃতি ও রাজনীতি তখন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত ছিলো। মুলত ঐ সময়টা ছিল এদেশের মুসলমানদের ধরমীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক, অথনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রে অধঃপতনের। এমনি যুগ সন্ধিক্ষণে শাইখুল হাদিস আল্লামা ওবায়দুল হক রাহ. জন্মগ্রহণ করেন।
আল্লামা ওবায়দুল হক রাহ. বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানিখ্যাত সিলেট জেলার জকিগন্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহন করেন। শিশুকাল থেকেই তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার সূচনা হয়েছিল পরিপূর্ণ ইসলামী আবহে। কৈশোরের সীমা অতিক্রম করা পর্যন্ত সুযোগ্য পিতা-মাতার তও্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। তখন তার গ্রাম ও পার্শবর্তী এলাকায় কোনো মাদরাসা ছিল না। এই অবস্থায়ই তিনি নিজ গ্রামের পাশেই একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর দুবাগ জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী এ বালকের প্রতি মক্তব ও স্কুলের শিক্ষকবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। ইতোপূর্বে তার উপর দৃষ্টি পড়ে আরেক রত্নের, তিনি হলেন সমাজ ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের নিবেদিত প্রাণব্যক্তিত্ব মাওলানা আমানুদ্দীন উজিরপুরী।
ফাযিলে দেওবন্দ আল্লামা ওবায়দুল হক’র মেধা ও জ্ঞান পিপাসা দেখে তিনি তার পিতা-মাতার পরামর্শে তার তত্ত্বাবধানেই তিনি রানাপিং মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই চতুর্দিকে তাঁর খ্যাত ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া সম্পন্ন করে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ঢাকার বড়কাটার আশরাফুল উলূম মাদরাসায় ভতি হন। তথায় আল্লামা যাকারিয়া রাহ.-এর শাগরিদ আল্লামা মুহিবুর রহমান যারোকাড়ি ও পীরজী হুজুর প্রমুখ এর তত্বাবধানে ইসলাম বিষয় শিক্ষা অর্জন করেন। পরে সেখান থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে তাঁর আপন উস্তাদ আল্লামা রিয়াছত আলী রাহ. এর নির্দেশে কানাইঘাট উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের লালারচক মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। মাএ ৩-৪ মাস শিক্ষকতার মাঝেই আল্লামা রিয়াছত আলী রাহ.’র অভিপ্রায় তার কাছে পৌঁছার পর ১৯৬০ সালে রানাপিং মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।
শিক্ষকতার দীর্ঘ জীবনে আল্লামা ওবায়দুল হক ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষাঙ্গনে তার বিরামহীন গতি অন্য থেকে আলাদা অবস্থানে নিয়ে আসে। তিনি হয়ে ওঠেন সবার প্রিয় শিক্ষক। একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রোজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে ওঠেন তিনি। দীর্ঘকাল যাবত শাইখুল হাদিসের পদে অধিষ্টিত থেকে ঈর্ষণীয় সাফল্য অজনে সক্কম হন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের অম্লান স্তূতি বহুকাল পযন্ত ধরে রাখবে ঐতিহ্যবাহী রানাপিং মাদরাসা। রানাপিং এর মাটি ও মানুষ তাদের প্রিয় উজিরপুরী হুজুরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে কালের পর কাল।
ইসলাম যেহেতু পূণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম, সেহেতু মাওলানা ওবায়দুল হক রাহ. শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হন। তিনি ছাত্রজীবনে জমিয়াতুওালাবা গঠনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে সম্পৃক্ত হন। উল্লেখ্য জমিয়াতুত্তালাবা ছিল ক্বওমি মাদ্রাসার ইতিহাসে গঠিত প্রথম ছাত্র সংগঠন। এটা ১৯৫৪ সালে ঢাকা উওর রানাপিং মাদরাসা থেকে যাএা শুরু করে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর হাতেখড়ি হয় শাইখুল হাদীস আল্লামা মুশাহিদ বায়ুমপুরী ও আল্লামা রিয়াছত আলী রাহ. চৌঘরীর হাতে! ১৯৮১ সালে হযরত মুহাম্মদ উল্লাহ হাফিজ্জী হুজুরের প্রসিডেন্ট নিবাচনে অংশগ্রহণ করে আলেমসমাজকে ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরমে একিভূত করেন। তিনি হাফেজ্জী হুজূরের প্রতিষ্ঠিত খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। কিছুদিন পর খেলাফত আন্দোলনে বিভক্তির সৃষ্টি হলে দেশের শীষস্থানীয় উলামায়ে কেরাম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবির সমন্বয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নামে নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্নাপ্রকাশ করে। তখন তিনি শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর হাত ধরেই সেই থেকে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজনীতির ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন!
একপর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির, ভারপ্রাপ্ত আমির, আমৃত্যু দলের অভিভাবক পরিষদের চেয়ারমান পদ অলঙ্কৃত করেন। স্বীয় মেধা ও যোগ্যতায় তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যথারীতি চালিয়ে যান। খেলাফত মজলিসের কেন্দ্র ঘোষিত সবকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রামে আল্লামা ওবায়দুল হক প্রথম সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশ-জাতি ও ইসলামের সিপাহসালারের ভৃমিকা পালন করেন। নাস্তিক মুরতাদ ও তসলিমা বিরোধী আন্দোলন, ধর্মদ্রোহীদের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের বিধান সম্বলিত ব্লাস্ফেমী আইন পাসের দাবী সংসদে উপস্থাপন করেন। বাবরি মসজিদ ভাঙায় সংসদে তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে বাবরী মসজিদ পুন:নির্মাণের দাবী জানিয়েছেন এবং শাইখুল হাদীসের ডাকে শান্তিপুর্ণ লংমার্চে গুলি করে ৫জনকে শহীদ করা হয় এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও তদন্ত কমিটি দাবী করেন এবং কওমী সনদের সরকারি সীকৃতির জন্য মুক্তাঙ্গনে শাইখুল হাদিস আজিজুল হক র: র সাথে অবস্থান করেন ।
১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নিবাচনে ৭টি ইসলামী দলের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী ঐক্যজোটের পক্ষ থেকে সিলেট-৫ আসনে নিবাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে নিবাচনে বিজয়ী হন! ফলে গোটা বাংলাদেশের ঐ সব দলের তথা ইসলামী ঐক্যজোটের একমাত্র জাতীয় সংসদরূপে তিনি জাতীয় সংসদে আসন গ্রহণ করেন। ঐ সময়ে গোটা বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ আলেম সমাজের তিনিই ছিলেন মূখ্য ভাষ্যকার ও একমাএ প্রতিনিধি। শাইখুল হাদীস আজিজুল হক রাহ. একদিন কোন মজলিসে বলেছিলেন, গোটা বাংলাদেশে অনেক উলামায়ে কেরাম আছেন তবে শাইখুল হাদীস ওবায়দুল হক একজন হাদীস বিশারদ ও এমপি। তাই উলামা সমাজে এম.পি সাহেব হূজুর বলতেই তাঁকেই বোঝায় এবং একনামেই গোটা দেশ তাঁকে চিনত। শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রাহ. ঐ বৃদ্ধ বয়সে জানাযায় হাযির হলেন যা কলবী মহববতের আলামত। অবশ্য ঐ সংসদে আরো একজন হক্কানী আলেম ও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন কিশোরগঞ্জের মাওলানা আতাউর রহমান খাঁন। কিন্তু তিনি আলেম সমাজের প্রতিনিধিরূপে নহে; বরং বিএনপি দলীয় সংসদরূপে নিবাচিত হয়েছিলেন।
ইসলামী ঐক্যজোটের একমাত্র এমপি হিসেবে ৬ষ্ট জাতীয় সংসদের বিভিন্ন অধিবেশনে আঞ্চলিক ও জাতীয় বিভিন্ন ইসু্যতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম শাহজালালের পু্ন্যভূমি সিলেট বিভাগের দাবী ও নোটিশ উপস্থাপন করে পার্লামেন্টে সিলেটি এমপিদের আস্থা অজনে সক্ষম হন ! তাই বলা যায় সিলেট বিভাগের প্রথম উপস্থাপক তিনি।
শাইখুল হাদীস ওবায়দুল হক রাহ.-এর মহান জীবনের একটি মহানিদর্শন শেওলা-জকিগঞ্জ রাস্তা। যেই রাস্তার পিছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। যেই রাস্তার জন্য এম পি হওয়ার পূর্বে অত্র অঞ্চলের সব জায়গা তিনি ঐ রাস্তার কথা আলোচনা করতেন।কুশিয়ারা নদীর ভাঙনের ব্যাপারে সংসদে বলতেন যে, বাংলাদেশের মানচিত্র পরিবর্তন হচ্ছে।
প্রতিটি বাজেট বক্তৃতায় অর্থনীতির সার্বিক সফলতার লক্ষ্যে ইসলামী অর্থনীতি অনুসরণ করার জন্য সংসদকে অবহিত করতেন এবং ইসলামী অর্থনীতির সুফল তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের দাবী জানান !
আল্লামা ওবায়দুল হক ৫ বছর সংসদে থাকাকালীন সময়ে সংসদ অধিবেশন না থাকলে দরসে হাদিসের টানে মাদ্রাসায় চলে আসতেন। আধ্যাত্মিকতার জগতে মাওলানা হক রাহ. ছিলেন প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত মাওলানা আব্দুল গফ্ফার শায়খে মামরখানী রাহ.-এর খলীফা। দীর্ঘ পরিশ্রম ও সাধনার শেষে ১৯৭৫ সালে তাজকিয়ায়ে ক্বলবের মেহনতের প্রাপ্তি হিসেবে স্বীয় মুর্শিদ হযরত শায়খে মামরখানী (রহ)’র কাছ থেকে ইজাজত হাসিলে সক্ষম হন ।
আপাদমস্তক সুন্নতী সাজে তিনি ছিলেন সারাজীবন সজ্জিত। জীবনের সর্বক্ষেত্রে সা্য্যিদুল মুরসালীন সা.’র আর্দশ প্রতিষ্ঠায় ছিলেন তৎপর। তাঁকে দেখলেই মনে হতো সুন্নতে রাসূলের এক জীবন্ত মূর্তপ্রতীক ।
তিনি ১৭ জানুয়ারি ২০০৮ সালে বৃহস্পতিবার রাতে ইন্তেকাল করেন এবং পরদিন ১৮ জানুয়ারি রোজ শুক্রবার আসরের নামাজের পর জানাজা নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। লাখো লাখো মানুষ টল নামে জানাজা মাঠে।
শেওলা টু জকিগঞ্জ রোডের পাশে ও উজিরপুর জামে মসজিদের পশ্চিমে সাবেক এম.পি. শাইখুল হাদীস আল্লামা ওবায়দুল হক উজিরপুরী রাহ.-এর দাফন সম্পন্ন করা হয় । তারই পাশে তারঁই বড় ছেলে আমি অধমের আব্বা বিশিস্ট সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী ডাক্তার শামছুল হক রাহ. কে সমাহিত করা হয়।
আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন ! আমীন ছুম্মা আমীন।
লেখক: ফাযিল, জামিয়া রাহমানিয়া সাত মসজিদ মুহাম্মদ পুর ঢাকা ।
পৌত্র, আল্লামা ওবায়দুল হক র:।