বরেণ্য আলিমে দ্বীন,মাও. শামসুল ইসলাম সাহেবের সংক্ষিপ্ত জিবনী
June 01 2020, 09:39
লিখেছেন- মুফতী রেজাউল করীম
উম্মতের দরদী,ত্যাগী একজন আলিমে দ্বীন। দ্বীনের দরদ নিয়ে যাঁরা মাঠে-ময়দানে ছুটে চলেছেন দিবানিশি,প্রভুর প্রেমালাপে জায়নামাজে গন্ডদেশ বিজিয়েছেন অশ্রুশিক্ত নয়নে। তাঁদের শ্রম-সাধনা কখনো বৃথা যায়নি। হাজার বাধা-বিপত্তি তাঁদের পথ রুখতে পারেনি। কঠিন থেকে কঠিনতম ষড়যন্ত্রে যাঁদের গায়ের লোম ও ঘামেনি।আল্লাহ ভীতি যাঁদের অন্তরে সর্বদা বিদ্যমান,নশ্বর জগতের কোন অপশক্তি তাঁদের রুখতে পারেনা।অন্যায়-অপশক্তির শেকড় ভাঙ্গতে নুসরতে ইলাহি তাঁদের নিত্য সঙ্গী।আল্লাহর চরণে তাঁদের সিজদাবনত শির সৃষ্টির সামনে কখনো নত হয়না। এমনি এক ব্যক্তিত্ব,অজো পাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া সংগ্রাম মুখর এক জীবনের নাম “মাওলানা শামসুল ইসলাম” দা.বা.।
নামঃ শামসুল ইসলাম। পিতাঃ হাজী নুরুল হক্ব। জন্মঃ-১২/০২/১৯৬০ সাল। সুনামগন্জ জেলাধীন শিল্পনগরি ছাতক থানার চরমহল্লাহ ইউনিয়নের চাঁনপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার- (দালানবাড়িতে) তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাথমিক লেখাপড়া :সুনামগন্জ সদরের বেতগন্জ বাজার “আনওয়ারুল উলুম মোল্লাপাড়া” মাদ্রাসা থেকে তাঁর শিক্ষাজীবনের সূচনা। ইবতেদায়ি জামাত থেকে ছরফ পর্যন্ত সেখানেই বিজ্ঞ উস্তাদগণের তত্বাবধানে ইলমে দ্বীন অর্জন করেন। তারপর চলে যান সিলেট তথা বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামী বিদ্যাপিঠ “জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার সিলেটে”। সেখানে নাহবেমির ও হেদায়াতুন নাহু পর্যন্ত পড়েন। তারপর চলে যান শিপ্লনগরী ছাতকের বছর দশেক কম শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহি দ্বীনি বিদ্যাপীট “দারুল হাদিস হাসনাবাদ” মাদ্রাসায়। সেখানে “দাওরায়ে হাদিস” পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
১৯৭৮সালে ক্বওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড বৃহত্তর এদারা বোর্ডে মেধাতালিকায় কৃতিত্তের সহিত হাদিসের সর্বোচ্ছ সনদ লাভ করেন। কর্মজীবনঃ দাওরায়ে হাদিস পাশ করার পর সর্বপ্রথম দোয়ারা বাজার উপজেলাধীন নলুয়া গ্রামে ইমামতি করেন। তারপর “আনওয়ারুল উলুম মোল্লাপাড়া” মাদ্রাসায় দুই বছর যাবত দ্বীনের খেদমত করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত নিজ গ্রাম চাঁনপুর জামে মসজিদের ইমাম,খতিব,ও ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জামেয়া দারুল কোরআন জলসি মাদ্রাসার মুহতামিম হিসাবে ইহতিমামীর দায়িত্ব নিষ্ঠা ও সততার পালন করেন। তখন অত্র এলাকায় জলসি মাদ্রাসার খুব সুনাম সুখ্যাতি অর্জন করে,আর এ সময়টুকুই অত্র প্রতিষ্ঠানের স্বর্ণযুগ হিশেবে স্বীকৃতি পায়। পারিবারিক জীবনঃ১৯৮৫ সালে শিল্পনগরী ছাতক থানার প্রসিদ্ধ তম জাউয়া বাজর ইউনিয়নের লক্ষমসোম গ্রামের মৃত চান্দ আলী সাহেবের দ্বিতীয় কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ব হন। ৪ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক তিনি।ছেলে ও মেয়েদের থেকে হাফিজ, মাওলানা,মুফতি, এবং প্রভাষক হিসাবে গড়ে তুলেছেন সবাইকে।
মসজিদ নির্মাণঃ ১৯৯৬ সাল বৃহত্তর গ্রাম(চাঁনপুর)। মসজিদে মুসল্লিদের সংকুলান হতো না,তাই গ্রামের পঞ্চায়েত মিলে সিদ্বান্ত নিলেন মসজিদ নবনির্মাণের। কিন্তু তখনকার গ্রামের লোকজনের আর্থিক অবস্থা ততটা উন্নত ছিলোনা।সলাপরামর্শের মাধ্যমে মসজিদের জন্য নতুন জায়গার ব্যবস্হা করা হলো,এবং নতুন জায়গায় মসজিদের জায়গা ভরাটের জন্য প্রত্যেক ঘর থেকে একেকজন সদস্যকে মাটি কাটার জন্য প্রস্তুত করা হল।এভাবে বিরাট জায়গায় মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর মসজিদের নির্মাণকাজ রাজাধীরাজ মহান আল্লাহ’র উপর ভরসা করে শুরু করা হয় এবং উনাঁর একনিষ্ঠ পরিশ্রম ও দাতাগনের সর্বাত্মক সহযোগিতায় মসজিদের নির্মাণকাজ সুসম্পন্ন হয়।
সমাজ থেকে শিরক-বেদাত দূরীকরণে তাঁর ভূমিকাঃশিরক সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন;”যে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করবে,আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন”। আর বেদাত সম্পর্কে তাঁর রাসূল সা.’র সতর্কবাণী হল; “প্রত্যেক বেদাতই হল পথভ্রষ্ঠ,আর প্রত্যেক প্রথভ্রষ্ঠই জাহান্নামী”। কিন্তু মুসলিম সমাজের বৃহত্তর একটি অংশ এই শিরক-বেদাতের মাঝেই লিপ্ত রয়েছে।উম্মতে মুসলিমার আলিম-দায়ীগণ এ ব্যাপারে জাতীকে সম্যক সতর্ক করে যাচ্ছেন।সমাজ সংস্কারের এ ক্ষেত্রে মাও. শামসুল ইসলাম দা.বা. অসামান্য অবদান রেখেছেন।তাঁর আশপাশে পরগাছার মত বেড়ে ওঠা নামধারী সুন্নীদের অসার কর্মধারা সম্বন্ধে তিনি নিত্য সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠা করেন;”চাঁনপুর হাফিজিয়া ইসলামীয়া মাদ্রাসা”।
এছাড়াও বিভিন্ন সভা-সেমিনার,এবং বেদাতীদের ডাকা কথিত বাহাস সমূহে তিনি আহলে হক্বের পক্ষ বুক চিতিয়ে দাড়িয়েছেন বারবার। নিম্নে এর ছোট্র একটি উদাহারণ পেশ করছি; নুর উদ্দীন জঙ্গি নামক এক ভ্রান্ত মতবাদী-বেদাতী আলিম একবার দোয়ারা বাজার ইউনিয়নের হাজিনগর গ্রামে আলমে ইসলামের অতন্দ্র প্রহরী দেওবন্দি উলামায়ে কেরামকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে ও বাহাস বাহাস বলে চিৎকার করতে থাকে।
উলামায়ে কেরামের পক্ষে তখন তনি একাই স্টেজে দাঁড়িয়ে নুর উদ্দীন জঙ্গির হাত থেকে মাইক্রোফন কেড়ে নিয়ে হাজার হাজার তাওহীদি জনতার সামনে এর দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন।মাজারী-বেদাতীদের মুখোশ উন্মোচন করে দেন।এমতাবস্থায় উপস্থিত সকলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যে,বিরুদ্ববাদিরা কি না কি করে বসে!!!।কিন্তু আল্লাহ তা’আলার অপার অনুগ্রহে উলামায়ে দেওবন্দের ঝান্ডাকে সমুন্নত রেখেই তিনি সেখান থেকে ফিরে আসেন।পরে স্হানীয় আহলে হক্ব উলামায়ে কেরাম ও জনসাধারণের প্রসংসায় পঞ্চমুখ হোন।বিরুদ্ধবাদীরাও থেমে থাকেনি,একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল বুনতেই থাকে,অবশেষে তারা সেহর/ যাদুর মাধ্যমে উনাঁকে কষ্ট দিতে আরম্ভ করে।মহান আল্লাহ সকল ষড়যন্ত্র কারীর ষড়যন্ত্র কে ধুলিস্মাৎ করে,উনাঁকে তাঁর রহমতের চাদরে আবৃত করে নেন। প্রবাস গমনঃ২০০৬ সালে তিঁনি দ্বীনের কেন্দ্রভূমি সৌদি আরবের মক্কা মোকাররামায় পাড়ি জমান। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠাঃ প্রবাস জিবনে পাড়ি জমালেও দ্বীনের ফিকির ছিলো তাঁর তনুমন জুড়ে বদ্ধমুল।
গ্রামের সহজ,সরল মানুষ যেন আল্লাহ,র খাটি গোলাম হয়,ও গ্রামের কোমলমতি শিশুকিশোররা যেন আল্লাহ,র কালাম সহিহভাবে শিখতে পারে,এ চিন্তা তাঁকে সবসময় পীড়া দিতো। ২০০৬ সালে গ্রামের গণ্যমান্য মুরুব্বিদের সাথে পরামর্শ ক্রমে ছাতকের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বীয় গ্রাম চাঁনপুরে গড়ে তুলেন- ইলমে নববির মার্কাজ “চাঁনপুর হাফিজিয়া ইসলামিয়া মাদরাসা”। সূচনাঃ মহান রবের উপর তাওয়াক্কুল করে, স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাড়িয়ে দ্বীনের মশাল জ্বালালেন।যে স্হানে আজ সুবিশাল দালানকোটায় মাদ্রাসাটি অবস্হিত। এক সময় সে স্থানটি ছিলো ডোবা ।
বুরো প্রজাতির ধানক্ষেত রোপন করতেন কৃষকরা।প্রথমে টিনসেডের একটি ছোট্র ঘরে শুরু হয় ইলমে নববীর দরস।পরে ধীরে ধীরে হাটি হাটি পা পা করে ইলমে নববীর এ দরসগাহ চতুর্দিকে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করতঃ আজকের এ পর্যায়ে। উন্নতি ও অগ্রগতির এ অভিযাত্রা অত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম সাহেবের নিরলস প্রচেষ্টা আর শেষ রাতে রুনা জারির ফসল।হযরতের প্রতিটা মোনাজাতে মাদ্রাসা কবুলিয়াতের উল্লেখ থাকে। মেতনতি একঝাঁক তরুণ আলেমদের দিনরাত মেহমতের বদৌলতে জামাত ও হিফজ বিভাগের লেখাপড়া চালু আছে।
প্রতিবছর হিফজ সম্পন্ন করে বের হন ২/৪ জন হাফিজে কোরআন। জামাত বিভাগে সরফ,নাহবেমিরের ফাইনাল পরিক্ষায় ও পবিত্র রমজান মাসে ক্বেরাত প্রশিক্ষণ আন্জুমানে তালিমুল কেরআন বাংলাদেশ’র মেধা তালিকায় সর্বোচ্চ স্হান বৃত্তি/মুমতাজ অর্জন সহ শতকরা ১০০% পাশের হারে অত্র প্রতিষ্ঠানের রয়েছে এক উজ্জল ইতিহাস। বর্তমানে মাদ্রাসাটি ৪০ হাত প্রস্ত ৬০ হাত দৈর্ঘ্য দুইটা বিল্ডিং ও সামনের দিকে একটি মনোরম মাঠ রয়েছে। ছাত্রদের খাবারের জন্য রয়েছে একটি লিল্লাহ বোর্ডিং যা গত দুই বছর যাবৎ ছাত্রদের জন্য অত্যন্ত স্বাস্থ্য সম্মত খাবার পরিবেশন করে আসছে।
উস্তাদ মোট ১২ জন, বাবুর্চি একজন, ছাত্র/ছাত্রী সংখ্যা মোট ৩০০ জন। বোর্ডিংয়ে অবস্হানরত ছাত্রের সংখ্যা মোট ৭০ জন। আল্লাহ তাঁর দ্বীনের খেদমত এভাবেই তাঁর খাটি বান্দাদের মাধ্যমে আন্জাম দিয়ে থাকেন।আল্লাহ পাকের দরবারে দ্বীনের খাদিম,বুযুর্গ এই আলিমের সুস্বাস্থ্য ও ক্ববুলিয়্যাত কমনা করতঃ তাঁর নেক হায়াত কামনা করছি।যেন আল্লাহ পাক তাঁর দ্বারা দ্বীনের আরোও খেদমত আঞ্জাম দেওয়ান।আমীন।