মাওলানা আকবর আলী রহ. এর আধ্যাত্মিক জীবন
November 10 2018, 09:15
লিখেছেন- মাওলানা আছাদ উদ্দীন>
পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে এ বিশ্বে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়ে যারা আল্লাহর ওলী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদের অনেকের কথাই অধিকাংশ লোক সম্যকরূপে অবহিত নয়। সত্যিকার পীর ও বুযুর্গদের জীবন বৃত্তান্তে রয়েছে ইহকালীন জীবনের অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডার।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবাগণের তিরোধানের পর পৃথিবীর বুকে ইসলাম ধর্ম ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করেছে যাদের অবিরাম প্রচেষ্টায়, তারা হলেন হক্কানী আলেম ও আউলিয়ায়ে কেরাম। ওলীআল্লাহদের নিরলস, নির্ভিক ও নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতেও দুনিয়াজুড়ে ইসলাম ধর্ম আরো প্রসার লাভ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে শর্ত হচ্ছে, পীর-বুযুর্গ হতে হলে হক্কানী আলেম ও সুন্নাতে নববীর পূর্ণ অনুসারী হতে হবে। একদা রাসূলে কারীম সা.কে জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করলেন, হুযুর ! আপনার ওয়ারিস কারা? জবাবে নবীজী সা. বললেন, পবিত্র কুরআন ও হাদিস যারা জানে এবং তদানুসারে আমল করে, তারাই হচ্ছেন উলামা।’ উপরোক্ত হাদিস দ্বারা আমরা উলমায়ে কেরাম তথা হক্কানি আলেম ও পীর বুযুর্গদের সংজ্ঞা জানতে পারলাম। আরও জানতে পারলাম পবিত্র কুরআন ও হাদিস শুধু জানলেই হবে না; মানতেও হবে। আবার কেবল মানলেই হবে না; বরং পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বিধি-নিষেধ, আদেশ-উপদেশ, অনুসরণে যথাযথভাবে আমলও করতে হবে। অতএব, যারা কুরআন ও হাদিস জানে, মানে এবং যথাযথভাবে আমলও করে তারাই হচ্ছে প্রকৃত উলামায়ে কেরাম। আর এরূপ উলামায়ে কেরামই হচ্ছেন নায়েবে রাসূল হওয়ার যোগ্য। এ রকম আলেমগণকেই বলা হয় হক্কানি আলেম তথা সত্যিকার পীর ও বুযুর্গ। এমনই অসাধারণ মানুষ ছিলেন আমার উস্তায ও পীর সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামি ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, ওলীকুল শিরোমণি, জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল রা.’র প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম হযরত আকবরী আলী ইমাম সাহেব হুযুর রাহ.।
জন্ম
আরিফ বিল্লাহ হযরত ইমাম সাহেব হুযুর রাহ.’র বয়স সম্পর্কে নানারকমের কথা প্রচলিত। কেউ বলেছেন নব্বইয়ের উপরে, আবার কেউ বলেছেন একশ বছরের উপরে। তবে হযরতকেও বয়স সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি জবাবে বলতেন, আমার বয়স যে কত হবে তা সঠিকভাবে আমিও বলতে পারবো না। আমি আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট তৈরী করতে আমার জন্মসন লিখেছি ১৯২০ ঈসায়ি। তবে বিভিন্ন তথ্যানুযায়ী ১৯১৬ সালে বিয়ানীবাজার উপজেলার মাটিজুরা টুকা (বর্তমান নাম ইসলামনগর) গ্রামের মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে হযরতের জন্ম হয়। তার ধর্মভীরু পিতার নাম জনাব আব্বাস আলী রাহ.। মাতার নাম মুহতারামা জহুরা বিবি রাহ.। মাত্র ছয়মাস বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। অতঃপর তিনি সৎ মায়ের তত্ত্বাবধানে প্রতিপালিত হন। অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির অধিকারী বর্ষিয়ান এই আলেমে দ্বীন বাল্যকালে অনেক দুঃখ-কষ্টের মাধ্যমে জীবনযাপন করেন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বজৈষ্ঠ। শৈশবকাল থেকেই ইসলামি অনুশাসনের প্রতি মাওলানা আকবর আলীর শিক্ষাজীবন আপন গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে শুরু হয়। ছয় বছর বয়সে তিনি মাথিউরা মাদরাসায় ভর্তি হন।
বাল্যকাল
ওলীয়ে কামেল বর্ষিয়ান বুযুর্গ আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ. জন্মের ছয় মাসের মাথায় মুহতারামা মাতাকে হারানোর পর পিতৃস্নেহ ও আপন মামা জনাব মন্তাজ আলী সাহেবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠেন। এভাবে তার জীবনের সাত-আটটি বছর কেটে যায়। মা ছাড়া সন্তানের বেড়ে উঠা ও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কতটুকু কষ্টসাধ্য তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। তারপরও আল্লাহর এই ওলী প্রচুর ধৈর্য, একাগ্রতা ও সুনামের সাথে লেখাপড়া চালিয়ে যান। তিনি যখন সিলেট সরকারি মাদরাসায় কামিল পড়ছিলেন তখন তার পিতৃছায়া মাথার উপর থেকে উঠে যায়। লেখাপড়ায় মনযোগ থাকার কারনে মা-বাবা হারানোর বেদনা তাকে দমিয়ে রাখতে পারে নি। কেননা আল্লাহপাকের ইচ্ছা ছিলো তাকে অসাধারণ মানব, সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইসলামি ব্যক্তিত্ব, প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন বানাবেন। আর বাস্তবে এ মহান ক্ষণজন্মা সাধক পুরুষ বয়সের ভারে ন্যূব্জ হলেও মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর মিশন চালিয়ে যান।
সব মহলে ইমাম সাহেব হুজুর খ্যাত আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ. বাল্যকাল থেকেই সুন্নাতে রাসূলের পুরোপুরি পাবন্দ ছিলেন। আযান শুনলেই জামাতের জন্য মসজিদে ছুটে যেতেন। আমি তাকে প্রায় তেত্রিশ বছর কাছ থেকে দেখেছি। সফরে-হযরে কোনো সময়ই জামাত ছাড়া নামায পড়তে কখনও দেখি নি। কোনো কারনে মসজিদ থেকে দূরে কোথাও গেলে জামাত পাওয়ার জন্য গাড়ি রিজার্ভ করে দ্রুত মসজিদে ছুটে আসতেন। পিতা-মাতা ইন্তেকালের পর মাওলানা আকবর আলী রাহ.’র মাঝে সব সময় একধরনের আনমনা ভাব পরিলক্ষিত হত। প্রখর মেধার অধিকারী ইমাম সাহেব হুযুর আকবর আলী রাহ. শৈশবকালে আসামভিত্তিক বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১ম স্থান লাভ করে তার অসাধারণ মেধার জানান দিয়েছিলেন। তৎকালীন তার উস্তায ও সহপাঠীরা ধারণা করেছিলেন একসময় এ আকবর আলী দ্যুতির বিচ্ছুরণ ঘটাবে। সময়ের ব্যবধানে তিনি তা প্রমাণ করতে সক্ষম হন। অতঃপর মাওলানা আকবর আলী রাহ. ১৯৩২ ঈসায়িতে সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে টানা সাত বছর কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া চালিয়ে যান। নিজ চারিত্রিক গুণে অল্প দিনেই সবার নজর কাড়েন। আলিয়া মাদরাসায় পড়াকালীন প্রথম ছয় মাস দক্ষিণ সুরমার তুতি মিয়ার বাড়িতে লজিংয়ে ছিলেন। এরপর নগরীর কুয়ারপারে সাচনার হাফিয আব্দুন নূর সাহেবের সাথে মেসে থেকে আড়াই বছর কাটিয়েছেন। মেসের খরচ বাবত প্রতি মাসে দেড় টাকা করে আদায় করতেন। ইমাম সাহেব হুযুর সরকারি আলিয়া মাদরাসায় ফাযিল পাশ করার পর তার খাস উস্তায আল্লামা সহুল উসমানী রাহ.’র সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম দেওবন্দের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে ভারতের মুরাদাবাদ শহরে একমাস অবস্থান করেন। সেখান থেকে রায়পুর শহরে গিয়ে এক মাদরাসায় ছয় মাস লেখাপড়া করেন। সেখানে কোনো অবস্থাতেই তার মন বসছিলো না। কেননা আল্লাহর ইচ্ছা ছিলো তাকে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যানিকেতন দারুল উলূম দেওবন্দে নিয়ে ইলমে যাহেরী ও বাতেনী দ্বারা ধন্য করা। রায়পুরে মন না বসায় ১৯৩৯ ঈসায়িতে মাদরে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। হযরত ইমাম সাহেব হুযুর রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দে একবছর তাফসির বিভাগে ও একবছর হাদিস বিভাগে অত্যন্ত পরিশ্রম ও সুনামের সাথে অধ্যয়নের পর দেশে ফিরে আসেন।
হিফযুল কুরআন ও কেরাত অধ্যয়ন
ইলমে ওহীর শিক্ষার্থীকে আল্লাহপাক সর্বদা সাহায্য করেন। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আবুদ্দারদা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারিম সা. ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য বের হয়, আল্লাহ তাআলা তাকে বেহেশতের পথ সুগম করে দেন এবং ফেরেশতারা তার জন্য নিজ ডানা বিছিয়ে দেন।’ (মিশকাত) আল্লাহ প্রদত্ত সাহায্য যেন সর্বদা ইমাম সাহেব হুযুর রাহ.’র সাথে থাকত। এ জন্য কুরআন মাজিদের হাফিয হওয়ার জন্য তাকে আলাদা কোনো সময় ব্যয় করতে হয় নি; বরং ছাত্রাবস্থায় লেখাপড়ার পাশাপাশি প্রতিদিন কুরআনের কিছু কিছু অংশ মুখস্ত করে হাফিয মু’তাসিম বিল্লাহকে শুনাতেন। এভাবে এক পর্যায়ে তিনি কুরআনের হাফিয হয়ে যান। ইমাম সাহেব হুযুর রাহ. নামায ও তিলাওয়াতে কুরআনের পাবন্দী করতেন। ফরয নামাযের জামাত সহ সকল নফল নামায মিলিয়ে কুরআন শরীফ প্রতিদিন প্রায় এক মনজিল তিলাওয়াত করতেন। যে কারনে প্রতি সপ্তাহে কুরআনের এক খতম হয়ে যেত। তিনি সারা বছরই কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আর রমযানে তো প্রায় ৪৫ বছর দরগাহ মসজিদে একাই খতমে তারাবিহে কুরআন শুনিয়েছেন। বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পর শেষ প্রায় দশ বছর মুসল্লিদের সুবিধার্থে মসজিদে এশার ফরয নামাযের জামাত পড়ানোর পর বাসায় চলে যেতেন এবং সেখানে দুই-তিনশ লোককে নিয়ে সালাতুত তারাবিহে কুরআন শরীফ শুনাতেন।
কর্মজীবন
মুর্শিদে কামিল মাওলানা আকবর আলী রাহ.’র কর্মজীবন শুরু এবং শেষ হয় ইমামতির মাধ্যমে। তিনি ঐতিহাসিক দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্তা মসজিদে তারাবিহের নামায পড়ানো সহ সিলেট দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ. মসজিদে সুদীর্ঘ ৫৮ বছর ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন।
কর্মজীবনের শুরুর দিকে তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলার আছিরখাল মাদরাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৭ ঈসায়িতে পাকিস্তান বিভক্তির ৬ মাস পূর্বে সিলেট শহরের নয়াসড়কে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে দরগাহ মসজিদের ইমাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই সময় আল্লামা সহুল উসমানী রাহ.’র প্রস্তাবে আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ.’র উপর দরগাহ মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব অর্পন করা হয়। ১৯৪৭ ঈসায়ি হতে ইন্তেকাল পূর্ব পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৮ বছর অত্যন্ত সুনাম, দক্ষতা ও সম্মানের সাথে দরগাহ মসজিদের খতিব ও ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। দরগাহ শরীফের দক্ষিণে মুফতি বাড়িতে লজিংয়ে থেকে ছাত্রদের কুরআন ও মাসআলা-মাসায়িলের পাঠদান শুরু করেন। এখান থেকেই বর্তমান ঐতিহ্যবাহী জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ.’ সিলেট মাদরাসার সূচনা। শুরুতে মাদরাসার নাম ছিলো তালিমুল কুরআন।
আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ. ইমামতির দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নামাজের পর মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে কুরআনের দরস দিতেন। এ দরসে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুসল্লিদের অন্তরে দ্বীন শেখার ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মহল্লার ছোট-বড় অনেকে ইলমে দ্বীন শিক্ষার জন্য মসজিদে এসে ভিড় জমান। আরিফ বিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী রাহ. দ্বীনি শিক্ষার আলোকে শাহজালাল রাহ.’র লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের কোনো প্রতিষ্ঠান গড়া যায় কি না? এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলেন। ইতিমধ্যে মুফতিয়ে আযম মুহাম্মদ শফী রাহ. এক সংক্ষিপ্ত সফরে সিলেটে আসলে মাওলানা হাফিজ আকবর আলী রাহ.কে দরগাহ সংলগ্ন একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিয়ে বলেন-মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে দাও, এখানে দারুন বরকত পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বীয় চিন্তাধারা ও প্রাণপ্রিয় উস্তাদের পরামর্শ ও দোয়ায় সমৃদ্ধ হয়ে ইমাম সাহেব হুজুর ২৭ জুমাদাল উলা ১৩৮১ হিজরি মোতাবেক ৭ই নভেম্বর ১৯৬১ ঈসায়ি সনে হযরত শাহজালাল রাহ.’র মসজিদ ও মাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে একটি দ্বীনি মাদরাসা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এ মাদরাসার নাম ছিল মাদরাসায়ে তালিমুল কুরআন দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ.সিলেট। ইমাম সাহেব হুজুর রাহ.’র রাতজাগা রোনাজারি, প্রচেষ্টা, সহযোগীদের একনিষ্ট পরিশ্রম ও এখলাসের বরকতে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তা’লিমুল কুরআন উত্তরোত্তর উন্নতির শীর্ষপানে পৌঁছতে শুরু করে। বছর কয়েকের মধ্যেই এ প্রতিষ্ঠান প্রাইমারি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তর অতিক্রম করে ১৯৭৪ ইংরেজী সনে দরসে নেজামীর সর্বোচ্চ জামাত তাকমীল ফিল হাদিস স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫ ঈসায়ি সনে তালিমুল কুরআনের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম সাহেব হুজুরের মুর্শিদ দারুল উলূম দেওবন্দের অর্ধ শতাব্দীর অধিককালের মুহতামিম আল্লামা ক্বারী মুহাম্মদ তায়্যিব রাহ. সংক্ষিপ্ত সফরে সিলেট আগমন করেন। তিনি এ তালিমুল কুরআনের ব্যাপক উন্নতি অবলোকন করে হাদিসে রাসূল সা. বলেন, “ইন্নাম আনা ক্বাসিমুন ওয়াল্লাহু ইউ’ত্বী” ‘আমি বণ্টনকারী, আল্লাহপাক জ্ঞানদানকারী নাম প্রস্তাব করেন। যা পরবর্তীতে ২৮/৫/১৩৯৫ হিজরি মোতাবেক ১১/৫/১৯৭৫ ঈসায়ি তারিখে অনুষ্ঠিত মজলিসে আমেলায় গৃহীত হয়। এর কিছুকাল পর ২০/০৬/১৪০৩ হিজরি মোতাবেক ০৫/০৪/১৯৮৪ ঈসায়ি তারিখে আরব বিশ্বের সাথে সমতা রক্ষার্থে উপমহাদেশের অন্যান্য মাদরাসার ন্যায় এ মাদরাসার নামের শুরুতে মাদরাসা এর পরিবর্তে জামেয়া শব্দ সংযোজন করে জামেয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল রাহ.’ সিলেট নির্ধারণ করা হয়। আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী রাহ.’র রাতজাগা রোনাযারি ও কঠোর পরিশ্রমে গড়ে উঠে এ জামেয়া। জামেয়ার সার্বিক উন্নয়নে যাদের অবদান অনস্বীকার্য, তন্মধ্যে শাহজালাল রাহ.এর মাজারের মোতাওয়াল্লী সরে কওম জনাব এ,জেড আব্দুল্লাহ সাহেব, সিলেট সরকারী আলিয়া মাদরাসার প্রবীন উস্তাদ আরশাদ আলী রাহ. মসজিদের প্রাক্তন ইমাম মাওলানা সায়্যিদ আলী কাছারী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বিশেষত সরে কওম এ.জেড আব্দুল্লাহ সাহেব দরগা এলাকায় পর্যাপ্ত জায়গা দান করে মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় যে বিরল অবদান রেখেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তিনি একদিকে ইমামতির দায়িত্ব যেমন সুচারুরূপে পালন করতেন। অন্যদিকে মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও ছিলেন খুবই দক্ষ ও অভিজ্ঞ। তিনি তাঁর রুমে অবস্থান করলেও ছাত্র-উস্তাদ, কর্মচারি সবাই সচেতন থাকতেন। এক দিকে যেমন সবাইকে স্নেহ-মমতা করতেন। অন্যদিকে নিচের বা উপরের শিক্ষক কর্মচারী যা-ই হোন না কেন, কোনো ধরণের ছাড় দিতেন না। তাঁর ইলমী ও আমলী মাকাম ছিল খুবই উঁচু। এ জন্য বড় বড় আলেম উলামাদের কাছেও তাঁর অত্যন্ত কদর ছিল। আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী রাহ.মাদরাসার হাল প্রথম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত খুবই শক্তহাতে ধরেছিলেন। কোন দিকেই তাঁর কোন গাফলতি বা সামান্যতম অবহেলা ছিলনা। হিসাব নিকাশের স্বচ্ছতার বেলায় উপমহাদেশের ২/৪টি মাদরাসার পরিচালক ব্যতিত তাঁর মত স্বচ্ছ ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুস্কর হবে। প্রথম থেকেই প্রায় সকল উস্তাদ ও ছাত্র মাদরাসায় অবস্থান করতেন। এ জন্য খানাপিনার বেলায়ও তাঁর নজর থাকত। মাঝে মাঝে নিজে ছাত্রদের খানা খেতেন, কমবেশি পেলে খানার মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করতেন, কেন এ রকম হলো? ভবিষ্যতে আর যেন এ রকম না হয়। আসাতিযায়ে কেরামের বেলায় তাঁর নজরে ঘাটতি ছিলো না। মাদরাসার উপস্থিতির সময় সব আসছেন কি না? শত ব্যস্ততার মধ্যেও সকাল ১০টার সময় উপস্থিত হয়ে হাজিরা খাতা তাঁর কাছে নিয়ে যেতেন। দুই-একজনের দেরি ধরা পড়লে বুঝাতেন-‘ ছাত্রদেরকে তাঁর মুরব্বিরা আমাদের কাছে আমানত দিয়েছেন, তাই আমাদের গাফলতি উচিত নয়। অন্যদিকে শায়খুল হিন্দ ও মুফতি মুহাম্মদ শফী রাহ.’র নসীহতও শুনাতেন। নসিহতটি হলো আমরা যে দায়িত্ব আদায় করছি তার বদলে সওয়াব দূরে থাক, আল্লাহপাক আমাদেরকে যদি পাকড়াও না করেন, তাহলে বাঁচা গেলো। মাঝে-মধ্যে কেউ কোন কিছু পীড়াপীড়ি করে বুঝানোর চেষ্টা করলে বলতেন, ভাই আমার দাঁড়িতো আর রৌদ্রে সাদা হয় নাই; আমার তো অভিজ্ঞতা আছে। বেশি বুঝানোর চেষ্টা করো না। আমি বড় মানুষ না হলেও আল্লাহ আমাকে অনেক বড় বড় মানুষের দেখা ও খেদমত করার সুযোগ দিয়েছেন। ইমাম সাহেব হুজুর অনেক সময় বিভিন্ন কেচ্ছা শুনাতেন তাঁর প্রতিটি কেচ্ছা দারুন নসিহতপূর্ণ ছিল। হুজুরের একটি অভ্যাস ছিল, তাঁর কোনো উস্তাদ বা উস্তাদের সন্তানাদি ছোট হোক বা বড় হোক সফরে আসলে যে কদিন তারা অবস্থান করতেন তাঁর সব নিজস্ব প্রোগ্রাম বাতিল করে সার্বক্ষণিক নিজে তাঁদের খেদমতে থাকতেন।
একদা দারুল উলূম করাচির মহাপরিচালক আল্লামা রফী উসমানী দা.বা. সিলেট আগমন করেন। ইমাম সাহেব হুজুর তাঁর সাথে খোশগল্প করতে যেয়ে কার জানি একটি নসিহত বললেন- ‘জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা নয়, আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা কর। অর্থাৎ মানুষকে খুশি করার চেষ্টা করলে ২/৪ জনকে খুশি করা যায়। এ কথাগুলো শুনে মুফতি রফী উসমানী খুশি হয়ে বেশ ক’বার জাযাকাল্লাহ বললেন। বিশ্ববরেণ্য ফক্বীহ আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. তাঁর সফরনামা জাহানে দীদা কিতাবের ৩৯১নং পৃষ্ঠায় লিখেন, হযরত মাওলানা আকবর আলী রাহ. ঐসব বুজুর্গদের একজন যিনি অতিশয় অমায়িক, বিনয়ী, আল্লাহর প্রেমে বিলীন; কিন্তু বিকশিত এবং কলুষমুক্ত। যার দৃষ্টান্ত এ যুগে কদাচিত পাওয়া যায়।
আল্লাহর এ নেক বান্দা অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হাজার হাজার আলেমের প্রিয় উস্তাদ ৮ নভেম্বর ২০০৫ ঈসায়ি মঙ্গলবার রাত ১১.৫৫ মিনিটের সময় ঢাকাস্থ পিজি হাসপাতালে বর্তমান বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান আল্লাহপাকের অহ্বানে সাড়া দেন। পরদিন বাদ যুহর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় এম.সি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে। সেখানে লক্ষ লক্ষ মুসল্লিদের উপস্থিতিতে জানাযার ইমামতি করেন সিলেটের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন খতীব উবায়দুল হক জালালাবাদী রাহ.। আমরা তাঁর মাগফিরাত ও দরজা বুলন্দির জন্য দোয়া করি এবং দোয়া করি আল্লাহপাক যেন আমাদেরকে আমাদের প্রানপ্রিয় উস্তাদ হযরত ইমাম সাহেব হুজুর রাহ.’র পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমাদের জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করেন। আমীন।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া ক্বাসিমুল উলূম দরগাহ হযরত শাহজালাল রাহ., সিলেট
সূত্র: কমাশিসা