ভূমিকা : সূর্য যেমনি উঠে আর ডুবে। মানুষও তেমনি জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে আবার মৃত্যু সুধা পান কের পরপারে চলে যায়। এভাবে দুনিয়াতে কত মানুষের আগমন-প্রস্থান ঘটে, তার হিসাব কে রাখে? তবে হ্যাঁ, কিছু কিছু মানুষ এমনও রয়েছেন, যাদের মৃত্যু দুনিয়াবাসীর জন্য হৃদয়ে রক্তকরণ ঘটায়। তাঁরা ভালোবাসার রাজপথ দিয়ে মানুষের আত্মার আত্মীয় হয়ে মনের গভীরে স্থান করে নেন। মোমবাতির ন্যায় নিজেকে বিলিয়ে অপরকে আলো বিকিরণ করেন। তাদেরই একজন হলেন মানুষ গড়ার কারিগর, সফল সংগঠক, তারুণ্যের অহঙ্কার, সুবক্তা, আদর্শ শিক্ষক, হকের পথে লড়াকু সৈনিক, ইসলামী আন্দোলনে দিকপাল, বাতিলের আতঙ্ক মাওলানা আব্দুল বাসিত গাজীনগরী রাহ.। তাঁরর কর্মবহুল বর্ণাঢ্য জীবনের সবগুলো দিক একটি মাত্র প্রবন্ধে আলোচনা করে শেষ করা যাবে না। কারণ, মানুষের ব্যক্তিত্ব ফুটন্ত ফুলের সৌরভের মত। একজন মানুষের সুন্দর ব্যক্তিত্ব অপরকে সহজেই বিমুগ্ধ করে। সেই ব্যক্তিত্ববান মানুষটিকে নিজের অজান্তেই অনুসরণ শুরু করেন।
বিদ্যার সাথে বুদ্ধিরও একটা সংযোগ থাকা দরকার। কোন সময় দেখা যায় শিক্ষিত লোক হয়েও শিক্ষার সদ্ব্যবহার করতে জানে না। হযরত মাওলানা আব্দুল বাসিত গাজীনগরী রাহ. স্বীয় পিতা সুলতানুল আওলিয়া তথা মদনী পরিবারের বুযুর্গদের সুহবতে নিজেকে ধন্য করেছিলেন। আরো এগিয়ে ফিদায়ে মিল্লাত রহ. তাঁকে ইজাজত ও খিলাফতে অলংকৃত করেছিলেন। তাই তো মাওলানা আব্দুল বাসিত শায়খে গাজিনগরী রাহ.’র কাছে বিনয়, শিষ্টাচার, রসবোধ, শব্দচয়ন, সঠিক উচ্চারণ ও শুদ্ধ প্রাঞ্জল ভাষার ব্যবহার ছিল লক্ষ্যণীয়। বক্তৃতায়র মুচকি হেসে অনর্গল কথার ফুলঝুরি তাঁর ব্যক্তিত্বে শোভা পেয়েছিল।
যাদের প্রতি আমাদের মনের টান, দুর্বলতা, ভক্তি-শ্রদ্ধা; যারা আমাদের হৃদয়ে অমর আসন করে বসে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম আদর্শ উস্তায হলেন মাওলানা শায়েখ আব্দুল বাসিত গাজীনগরী রাহ.।
তাঁর ইন্তেকালে জাতি হারিয়েছে দ্বীনের অতন্দ্র এক প্রহরীকে। আল্লাহওয়ালা এক বুযূর্গকে। সুযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তানকে। তিনি বেঁচে নেই তবে তার জীবনাদর্শের মৃত্যু হয়নি। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর বর্নাঢ্য জীবনের বাকে বাকে আকাশচূম্বী জনপ্রিয়তার রাজ প্রসাদে।
জন্ম : হযরত মাওলানা আব্দুল বাসিত গাজীনগরী রহ. সুনামগঞ্জ জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার অন্তর্গত গাজীনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবার কুতবে আলম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র খলীফা ওলীকুল শিরোমনি, হক্কানী উলামায়ে কেরামের নয়নমনি, হযরত মাদানী রাহ.’র সফল স্বার্থক রুহানী সন্তান, বাতিলের সাথে আপোষহীন সৈনিক, লক্ষ মানুষের পীর ও মুর্শিদ, দারুল উলূম দরগাহপুর মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা হযরত শায়খ আব্দুল হক গাজীনগরী মদফুনে মক্কী রাহ. ও মরহুমা মমতাজ বেগমের ঔরশে ১৩৭৫ বাংলার ১৯ শে মাঘ রোজ রবিবার সকাল ১০ ঘটিকার সময় এ ভূমে তিনি শুভাগমন করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা : জন্মের পর ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান হিসেবে ৪ বছর বয়সে আপন পিতা মাতার কাছে লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয়। কিছুদিন পর হযরত শায়খে গাজীনগরীর প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম দরগাহপুর মাদরাসায় ভর্তি হন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর পিতার নির্দেশে সিলেট জেলার অন্যতম বিদ্যাপীঠ জামেয়া কাসিমুল উলূম দরগাহ মাদরাসায় ভর্তি হন।
মাধ্যমিক শিক্ষা : সেখান থেকে তদীয় পিতার নির্দেশে দারুল উলূম দরগাহপুর মাদরাসায় আবার চলে আসেন। এখানে তিনি কুরআন, হাদীস, ফিক্বহ, উসুলে ফিকহ, আরবী সাহিত্য, বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ প্রভৃতির শিক্ষা লাভ করেন।
আঞ্জুমানে সিপাহে সাহাবা সুনামগঞ্জ
দরগাহপুর মাদরাসায় লেখাপড়ার সময় হযরত মাওলানা আঞ্জুমানে সিপাহে সাহাবা নামক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে আঞ্জুমানে তাহাফফুজে দ্বীন নামে রূপধারন করে। তিনি একজন সফল সংগঠক ছিলেন। তাঁর হাতেগড়া কর্মীরা তাঁর এই রেখে যাওয়া আমানতের কাজ এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন।
উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য দারুল উলূম দেওবন্দ সফর : মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর পিতার নির্দেশে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দ গমন করেন এবং তথায় উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করে দেশে ফিরেন।
দাওরায়ে হাদীসে তাঁর শিক্ষকবৃন্দ : হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী, হযরত মাওলানা নছির আহমদ খান, মাওলানা সাঈদ আহমদ পালনপুরী, ক্বারী উসমান মনছুরপুরী, হযরত মাওলানা আব্দুল হক আজমী প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিবর্গ।
তাছাউফ বা আধ্যাত্মবাদে শিক্ষালাভ : উচ্চ শিক্ষা লাভের পর তাছাউফ বা আধ্যাত্মবাদের সবক নেওয়ার জন্য ফেদায়ে মিল্লাত হযরত আসআদ আল মাদানী রাহ.’র হাতে বয়আত গ্রহণ করেন এবং খেলাফত লাভে ধন্য হন।
কর্ম জীবন : উলূমে জাহেরী ও উলূমে বাতীনী লাভের পর আপন পিতার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা দারুল উলূম দরগাহপুর মাদরাসায় দারস ও তাদরীসের মধ্য দিয়ে কর্ম জীবনের সূচনা করেন। এখানে দীর্ঘ ৩ বছর সুনাম সুখ্যাতির সাথে শিক্ষকতার দায়িত্ব আদায় করেন। এ সময় তিনি একটা কেরাত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠা করেন। অত:পর বর্মা উত্তর রামনগর মাদরাসায় শিক্ষকতার গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দেন দীর্ঘ ৫ বছর। আবার দরগাহপুর মাদরাসায় চলে আসেন। আমৃত্যু দরগাহপুরেই ছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন : মরহুম মাওলানা আব্দুল বাসিত রাহ. আজীবন হক ও হক্কানীয়তের পতাকাবাহী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছেন।
বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : দ্বিতীয় বার দরগাহপুর মাদরাসায় শিক্ষকতার সময় এই মহান কর্মবীর ভাবতে থাকেন যে, ধর্মীয় শিক্ষা যেমনভাবে পুরুষের জন্য ফরয তেমনিভাবে মহিলাদের জন্যও ফরয। অথচ আমাদের দক্ষিণ সুনামগঞ্জে মহিলা মাদরাসা নেই বললেই চলে। তাই তিনি নিজ বাড়ীতে সন ১৪০৯ বাংলা হতেই ছোট ছোট বালিকাদের অস্থায়ীভাবে পাঠদান শুরু করেন। পরবর্তীতে তদীয় পিতা হযরত শায়খে গাজী নগরী রাহ. ৪০ শতাংশ জায়গা মহিলা মাদরাসার জন্য ওয়াকফ করে দেন। এবং আউলাদে রাসূল ফেদায়ে মিল্লাত হযরত মাওলানা আসআদ মাদানীকে নিয়ে ভিত্তি রাখেন। ৩য় তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ঘরের কাজ শুরু হয় এবং অল্প দিনের মধ্যেই ১ম তলার কাজ পূর্ণ হয়ে যায়। বর্তমানে ২য় তলার কাজ শেষ হয়ে গেছে। মরহুম মাওলানা যে একজন কর্মবীর ছিলেন মাদরাসাটি ১ নজর দেখলেই তা প্রতীয়মান হয়।
রচনাবলী : মাওলানা আব্দুল বাসিত রাহ. আজীবন ইসলামের খেদমত আঞ্জাম দেয়ার পাশাপাশি যেমনিভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন তেমনিভাবে পুস্তক রচনায়ও যথাসাধ্য নিজের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখেছেন। নিম্নে তাঁর রচিত কয়েকটি পুস্তকের নাম উল্লেখ করা হল। ১. সেবার নামে যাতনা ২. এক্সরে রিপোর্ট ৩. মমতাজ তালিমুস সিবয়ান ৪. ক্বোরআন শিখি হাদীস পড়ি ৫. উসুলে তাজবীদ প্রভৃতি। এছাড়া বিভিন্ন সময় তার লিখিত প্রবন্ধ এবং কবিতা বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশ করা হত।
ইন্তেকাল : কর্মবীর মহা মনীষী আমরণ সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা আব্দুল বাছিত তাঁর জীবনের শেষ দিনটি ও ব্যয় করেছেন ইসলামের প্রচার ও প্রসারে। ইন্তেকালের দিন তিনি কামারগাঁও মাদরাসার বার্ষিক জলসায় যান। সেখানে মাওলানা ফজলুল হক সাহেবের বাড়ীতে জুহরের নামাজ পড়েন। এবং নামাজান্তে জমজমের ১ গ্লাস পানি পান করেন। কিছু সময় পর বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। ঐ দিনই রাত ৭টা ২০ মিনিটের সময় শতাব্দীর অন্যতম প্রতিভা, অসংখ্য গুণের সমন্বয়কারী বিরল ব্যক্তিত্ব মাওলানা আব্দুল বাসিত গাজীনগরী আল্লাহ আল্লাহ উচ্চারণ করতে করতে মাওলায়ে হাকীকীর সাথে মিলিত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৮ বছর। তিনি স্ত্রী ৩ ছেলে ১ মেয়ে ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।
জানাযা ও কাফন-দাফন : ২২ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বিকাল ২.৩০ মিনিটে দরগাহপুর মাদরাসা মাঠে তাঁহার বিশাল নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল তাঁর নামাজে জানাযায়। ইমামতি করেন তাহার শ্রদ্ধেয় পিতা হযরত আব্দুল হক গাজীনগরী মদফুনে মক্কী রাহ.। তার হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান বালিকা বিদ্যালয়ের পাশে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাত নসীব করুন। আমীন।