মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
April 28 2019, 10:36
প্রবীণ রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব সমাজসেবী মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনের অন্যতম অগ্রসৈনিক। ইলমে দ্বীনের শিক্ষাদানের মাধ্যমে অগণিত শিক্ষার্থীদের আলোকিত ভূবনে নিয়ে যাওয়ার এক নেপথ্য কারিগর তিনি। জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে। দ্বীনের খেদমত তথা ইসলাম প্রচার, অনৈসলামিক কান্ড প্রতিরোধে ও বাতিল শক্তির মোকাবেলায় তিনি এক বলিষ্ঠ তেজী ও সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব। প্রবীণ আলেমে দ্বীন ও শিক্ষাবিদ হিসেবে সকল মহলে রয়েছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি।
তিনি ১৯২৮ সালে সিলেটের বিশ্বনাথ থানাধীন ঘড়গাঁও গ্রামে এক দ্বীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মরহুম জওয়াদ উল্লা এলাকার সুপরিচিত পরহেজগার ও মানবতার কল্যাণে ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ। মাতা-হাবিবুন্নেছা ওরফে জয়তুন বিবি একজন গুণবতি বুদ্ধীদীপ্ত পরহেজগার মহিলা হিসেবে নিজ এলাকায় মহিলা সমাজে ছিলেন সুপরিচিতা। তাঁর অমায়িক ব্যবহার ছিল সকলের কাছে অনুকরণীয়।
তিনি পিতা-মাতার কাছ থেকে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করেন। স্থানীয় মসজিদের ইমাম মরহুম মাওলানা ছানাউল্লা সাহেবের নিকট প্রাথমিক আরবী ও কুরআনুল কারীমের ছবক গ্রহণ করেন। অত:পর বিশ্বনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিটি ক্লাসে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং পঞ্চম শ্রেণী পাশ করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন জনাব আবরু মিয়া ও জনাব কানাই মিয়া। ১১ বছর বয়সেই তিনি বৃটিশ বিরোধি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন বুকে ব্যাজ ধারণ করত: (যাতে লিখা ছিল ) সাহসিকতাপূর্ণভাবে উক্ত আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশ গ্রহণ করতে থাকেন। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা সভায় কিছু শর্তসাপেক্ষে কুতুবুল আলম আল্লামা হোসাইন আহমদ মাদানী র. বিশ্বনাথ পশ্চিম বাজারে আগমণ করলে এতে তিনি সক্রিয় কর্মী হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তের পর তিনি রামসুন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬/৭ মাস অধ্যয়ন করেন। এরপর মৌলভীবাজার ইটাপরগনা নিবাসী মাওলানা আব্দুল কাদির র. বিশ্বনাথের দৌলতপুরে একটি কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে পিতার ইচ্ছানুযায়ী আশরাফ আলী এতে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। সেখানে তাঁর উস্তাদ ছিলেন-মাওলানা আব্দুল গণী মিরেরচরী র., মাওলানা সিকান্দর আলী বালাগঞ্জী প্রমুখ। অত:পর তাঁর পিতার অনুরোধে পাটলী নিবাসী মাওলানা শায়খ নুরুল গণী র. তাঁকে রানাপিং মাদ্রসায় ভর্তি করে দেন। সেখানে তিনি ছাফেলা দ্বিতীয় বর্ষ থেকে মিশকাত পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। সেখানে তাঁর উস্তাদদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিলেন মাওলানা মুস্তাকিম আলী র., মাওলানা রিয়াছত আলী র., মাওলানা তাহির আলী র., মাওলানা আব্দুর রশিদ র., মাওলানা মুকাম্মিল আলী র., মাওলানা শামসুল ইসলাম র., মাওলানা আব্দুুল মতিন চৌধুরী র., মাওলানা মনোহর আলী র. প্রমুখ। উচ্চশিক্ষা হাসিলের লক্ষ্যে তিনি মাওলানা রিয়াছত আলী র.-এর পরামর্শ ক্রমে চট্রগ্রাম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে দাওরায়ে হাদীস প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। সেখানে তাঁর উল্লেখযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব র., মাওলানা আব্দুল আজিজ র., মাওলানা মুফতি ফয়জুল্লাহ র., মাওলানা মুফতী আহমদুল হক, মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব প্রমুখ। মাসিক মঈনুল ইসলাম নামক ম্যাগাজিনে সে সময় দস্তারবন্দী সম্মেলন সংখ্যায় উক্ত মাদ্রাসার ৮০০ জন ফারেগ ছাত্রের মধ্যে ১০০ জনকে মেধা তালিকায় উত্তীর্ণ বলে উল্লেখ করা হয় এবং ১০০ জনের মধ্যে মাওলানা আশরাফ আলীর স্থান ২৭ তম। তাঁর মেধা তালিকায় এ অবস্থান তাঁর মেধাশক্তির স্ফুরণ বলেই অনুমিত হয়।
ছাত্র জীবন থেকেই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪৪ সালে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন চারখাই নিবাসী মাওলানা মছদ্দর আলী র.-এর নেতৃত্বে সিলেট শহরের কুদরত উল্লাহ জামে মসজিদ থেকে যে মিছিল বের হয়েছিলো তিনি এ কর্মসূচীর একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯৪৬ সালে আসাম প্রাদেশিক সংসদ নির্বাচনে তিনি বিশ্বনাথ থেকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রার্থী মৌলভী শায়খ সুলায়মান খাঁ র.-এর পক্ষে প্রত্যক্ষ নির্বাচনী প্রচারণায় উল্লেখ্যযোগ্য অবদান রাখেন। তখন উক্ত আসনে জমিয়ত প্রার্থী অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেও আসাম প্রদেশ থেকে তিনজন প্রার্থী নির্বাচিত হন। সমগ্র আসামে জমিয়তের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা ইসলামী রেনেসাঁয় আরেক ধাপ অগ্রগতির সঞ্চার করে। বিভিন্ন সময় তখন জমিয়তের রাজনীতিন সাথে জড়িত হওয়ার অপরাধে তিনি প্রতিপক্ষের বিদ্বেষ ও আক্রমণের শিকার হন।
কর্মজীবনে ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দারুসসুন্নাহ গলমুকাপন মাদ্রসায় অধ্যাপনা করেন। তাঁর পিতার অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি ১৯৫৪ সালে শমেমর্দান তাওয়াক্কুলিয়া মাদ্রাসায় ৩ বছর অধ্যাপনার পর অসুস্থ্য পিতার সেবা শুশ্রƒষা করার জন্য নিজ বাড়ীতে চলে আসেন। ১৯৫৮ সালে পারকুল মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদিয়ে ১ বছর অধ্যাপনা করেন। বিশ্বনাথ এম.এ.ই মাদ্রসায় এইড বন্দ হয়ে গেলে তিনি এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মাদ্রাসাটির কার্যক্রম আবার শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ও পরিশ্রমে এবং দ্বীন দরদী এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতায় ও ক্বওমী মাদরাসাটি বর্তমানে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি ১৯৫৮ সাল থেকে অদ্যবধি এ মাদ্রাসার অত্যন্ত কর্মদক্ষথা সম্পন্ন অধ্যক্ষ হিসেবে অধিষ্টিত আছেন।
১৯৬১ সালে তাঁরই প্রস্তাবে উক্ত প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বনাথ বাজারে নদীর উত্তর পারে স্থাপিত এবং এলাকার মুরুব্বী মাষ্টার আলতাফুর রহমান, মরহুম মেম্বার হাজী তবারক আলী, মরহুম হাজী তোতা মিয়া ও ফজলু রহমান প্রমুখদের সহযোগিতায় বিশ্বনাথ উত্তর পারের নতুন বাজার চালুর ব্যাপারে তাঁর রয়েছে বিরাট অবদান। ১৯৪৭ সালে সিলেটকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রেক্ষিতে রেফারেন্ডামে অংশ গ্রহণের অপরাধে তিনি প্রতিপক্ষের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হন। ১৯৬৪ সালে তিনি বৃহত্তর সিলেট জেলা জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত একই সাথে বৃহত্তর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পারন করেন। আজ অবদি তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রয়ি সহ-সভাপতি হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বিভিন্ন সময় সাংগঠনিক গতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিঃস্বার্থভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তৎকালীন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ মাওলানা মুফতী মাহমুদ র., মাওলানা গোলাম গৌছ হাজারভী র.-এর সাথে সার্বক্ষনিক যোগযোগ রক্ষা করে সাংগঠনিক কার্যক্রমকে জোরদার করে তোলেন। পরবর্তীতে উক্ত নেতৃবৃন্দ আল্লামা আব্দুল্লাহ দরখাস্তী র. সহ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমগ্র পাকিস্তান সফর করে সংগঠনকে মজবুতরূপে গড়ে তোলতে সক্ষম হন।
১৯৬৮ সালে ১ মে লাহোরে সংগঠনের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলে মাওলানা আশরাফ আলী ১২জনের প্রতিনিধি দলসহ সেখানে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালের ২৬, ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সারগোধা শহরে নিখিল পাকিস্তান কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হলে সেখানে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ২০ জন প্রতিনিধি দলের অন্যতম হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা উপলক্ষে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোস্টেলে তিনি মাওলানা মুফতী মাহমুদ র., মাওলানা কাসেমী ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান প্রমুখের সাথে উপস্থিত ছিলেন এবং তৎকালীন সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সেখানে আলোচনায়ও অংশ নেন।
১৯৮৮ সালের ১২ মার্চ তিনি মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে ভারত সফরে যান। সেখানে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা থানাবন্দ শাহরানপুর, মাওলানা তাহের সাহেবের কলকাতা মাদানীয়া মাদ্রাসা, গাঙ্গুহ শরীফ, কলিয়ার শরীফ, দিল্লীর জমিয়ত কার্যালয়সহ প্রসিদ্ধ স্থান সমূহ পরিদর্শন করেন। ১৯৮৭ সালের ১০ জুন ইরাক সরকারের ওয়াক্ফ ও ধর্ম মন্ত্রনালয়ের আমন্ত্রণে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে জমিয়ত নেতা মাওলানা সামসুদ্দীন কাসেমীর নেতৃত্বে ৬ জনের প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা হিসেবে ইরাক সফর করেন।
ইরাকে নিয়োজিত
সৌজন্যে- শায়খ মাওলানা তাজুল ইসলাম