মাওলানা ইবরাহিম আলী রা. এর সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম
February 24 2021, 04:06
লিখেছেন- মুফতি আহমদ রাফি জাকির
যুগে যুগে কিছু মুসলিম মনীষীগণ দেশ,জাতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইসলামি তাহযীব-তামাদ্দুনের আন্দোলনে নিজের জিবনকে বিলিয়ে দিয়ে ইতিহাসের পাতায় অমর হয় থাকেন। পরবরর্তি প্রজন্মরা ঠিকই তাদেরকে আদর্শ রাহবার হিসাবে স্বরণ করে। কিন্তু আমাদের সমাজে গুণীজনের প্রকৃত মূল্যায়নের অভাবে বহু যুগসচেতন, সমাজ সংস্কারক,ওলিয়ে কামেল, মহা-সাধকদের পরিচয় জানা থেকে আমরা বনচিত হই। তাদের অন্যতম একজন হলেন- শায়খুল হাদিস আল্লামা ইবরাহিম আলী মুহাদ্দিসে কটারকােনি রাহ.
জন্ম: মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া থানাধীন কটারকােনা গ্রামে। যুগের এক খ্যাতিমান মনীষী, আল্লামা আব্দুস সবুর দেওবন্দী রা. ঔরষে যুগশ্রেষ্ঠ ওলিয়ে কামেল, আল্লামা ইবরাহিম আলী কটারকােনি রা. ১২ আগস্ট ১৯৪৩ সালের কােন এক শুভদিনে এই বসুন্ধরায় আগমন করেন।
প্রাথমিক শিক্ষা. হযরতের প্রাথমিক শিক্ষা ও হাতেখড়ি তার সম্মানিত পিতা মাও. আব্দুস সবুর দেওবন্দি রা. নিকট সমাপ্ত করেন। পরবর্তিতে কটারকােনা নয়াবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমেই তার একাডেমিক পড়া-লেখার সূচনা হয়। কটারকােনা নয়াবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অত্যান্ত সুনামের সাথে পড়া-লেখা করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া-লেখা শেষ করে ভর্তি হন কটারকােনা নয়াবাজার কে.সি হাই স্কুলে। সেখানে তিনি এস. এস. সি পর্যন্ত পড়া-লেখা করার পর ভর্তি হন তার আসল গন্তব্য মাদারিসে ক্বাওমিয়ায়। প্রথমে তিনি ভর্তি হন, কমলগন্জ থানার ঐতিহ্যবাহি প্রতিষ্ঠান। ভানুগাছ জামেয়া ইসলামিয়া ক্বওমি মাদরাসায়। সেখানে কিছুদিন মুতাওয়াসসিতাহ্ বিভাগে পড়া- লেখা করার পর ভর্তি হন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ, শায়খুল হাদিস আল্লামা নুরুদ্দীন গহরপুরি রা. প্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহি শিক্ষাগার।
জামেয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুর, সিলেট। জামেয়া হুসাইনিয়া গহরপুর মাদরাসায় অত্যান্ত সুনামের সাথে দাওরায়ে হাদিস সমাপন করেন। দাওরায়ে হাদিস সমাপন করে ইলিমে ওহি শেখার স্পৃহা আরাে বেড়ে যার। এবং তিনি দেশের সীমানা পেরিয়ে “রেহলাতুল ইলিম” করে চলে যান পাকিস্হানে। সেখানে তিনি জামেয়াতুল উলুম আল- ইসলামিয়া আল্লামা বান্নুরী টাউন করাচি, পাকিস্তানে দাওরাতুল হাদিসে ভর্তি হন। আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমিরি রাহ. হাতেগড়া শাগরীদ। তার ইলিম ও মাআরিফের যিম্মাদার। তিরমিযি শরীফের জগৎ বিখ্যাত শরাহ। মাআরীফুস্ সুনানের মুসান্নিফ, আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী রা. নিকট, তিনি পূর্ণ বুখারী শরীফ পড়েন। এবং শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ অন্যতম শাগরীদ, আল্লামা ওলি হাসান টুংকি রা. তিরমিযি শরীফ। আল্লামা ফজল মুহাম্মদ সাহেব রা. নিকট পূর্ণ আবু দাউদ শরীফ পড়েন। আল্লামা বদিজ্জামান সাহেব রা. নিকট নাসাঈ. ইবনে মাজাহ. ও মুআত্তাইন এবং আল্লামা মিছবাউল্লাহ শাহ সাহেবের নিকট তাহাবি শরীফ সহ আরও যুগশ্রেষ্ঠ খ্যাতিমান মুহাদ্দিসিনে কেরামদের নিকট হাদিস অধ্যয়ন করেন।
করাচি বান্নুরি টাউন পাকিস্তানে পড়ার সময় তার সাথে বাংলাদেশের যারা পড়েছেন। তাদের একজন হলেন। বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। শায়খুল হাদিস, আল্লামা শায়খ মাহমুদুল হাসান যাত্রাবাড়ি দা: বা:
কর্মজীবন. জামেয়াতুল উলুম আল- ইসলামিয়া আল্লামা বান্নুরী টাউন করাচি, পাকিস্তান, থেকে অত্যান্ত সুনামের সাথে দাওরায়ে হাদিস সমাপনের পর পাকিস্তানে এক বছর দ্বীনের খেদমত করেন। বাংলাদেশে আসার পর প্রথমে তিনি সৈয়দপুর ইসলামিয়া মাদরাসা, রংপুরে হাদিসের খেদমত করেন। পরে আপন উস্তাদ, উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ, শায়খুল হাদিস আল্লামা নুরুদ্দিন গহরপুরি রা. ডাকে চলে আসেন, তার প্রিয় মাদরে ইলমি। জামিয়া ইসলামিয়া হুসাইনিয়া গহরপুর, সিলেট। সেখানে তিনি সিনিয়র মুহাদ্দিস হিসাবে নিযুক্ত হন। ইলমে হাদিসের গ্রহণযােগ্য কিতাব সহিহ মুসলিম শরীফ দরস প্রদান করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালিন সময়ে হযরত শায়খে গহরপুরি রাহ. সাথে হযরত কটারকােনি রাহ. ১৮ দিন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী জিবন কাটান। পরে জেল থেকে ছাড় পেয়ে ১৯৭১ সালের মে বা জুন মাসে ভয়াবহ পরিস্হিতির মধ্য দিয়ে পনের দিন পায়ে হেটে আপন নিড়ে ফিরে আসেন। যুদ্ধ পরবর্তিতে মৌলভীবাজার ঐতিয্যবাহি প্রতিষ্ঠান। জামেয়া ইসলামিয়া কর্মধা মাদরাসায় খেদমতে যােগ দেন। দেশ স্বাধীনের পর কর্মধা এলাকায় দ্বীনের মাহওয়াল তৈরী করার পিছনে বিরাট মেহনত করেন। ১৯৭৬ সালে কর্মধা মাদরাসা হতে ঢাকাদক্ষিণ জামেয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় অত্যান্ত সুনামের সাথে হাদিসের দরস প্রধান করেন। সেখান ১৯৭৭ সাথে চলে আসেন, আপন জেলার অন্যতম দ্বীনি দরসগাহ।
জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মৌলভীবাজার মাদরাসায়। সেখানে বছর খানেক পড়ানাের পর কর্মধার মুরাব্বিয়ানে কেরামদের অনুরোধে আবারও চলে আসেন কর্মধা মাদরাসায়। এবং১৯৭৯ সালে কর্মধা মাদরাসার মুহতামিম পদে নিয়ােগপ্রাপ্ত হন। ১৯৮১সাল পর্যন্ত কর্মধা কুলাউড়া মাদরাসায় এহতেমামের দায়িত্ব অত্যান্ত সুষ্ঠুভাবে পালন করেন। অত:পর ১৯৮২সালে চলে আসেন তার ওয়ালিদে মুহতারাম, শায়খ আল্লামা আব্দুস সবুর দেওবন্দী রা. প্রতিষ্ঠিত, জামেয়া হুসাইনিয়া কটারকােনা মাদরাসায়।
জামেয়া হুসাইনিয়া কটারকােনা মাদরাসায় কিছুদিন পড়ানাের পর চলে যান (মনু স্টেশন সংলগ্ন) ফজল বাগ জামেয়ায়। তার জীবনের সিংহবাগ সময়ই কাটান ফজলবাগ মাদরাসায়। ফজলবাগ মাদরাসা হতে বিদায় গ্রহণের পর অল্প কিছুদিন খেদমত করেন, মৌলভীবাজার বর্ষিজােড়া মাদরাসায়। পরে আবার চলে আসেন তার ওয়ালিদে মুহতারামের প্রতিষ্ঠিত কটারকোনা হুসাইনিয়া মাদরাসায়। এবং ২০০৯ সালে এলাকাবাসির অনুরােধে তিনি মুহতামিমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার মৃত্যু অবধি অত্যান্ত সুচারুভাবে এহতেমামের মহান কাজ পরিচালনা করে যান।
সামাজিক জিবন. এই ঘুণে ধরা সমাজ সংস্কারে ও শুদ্ধিকরণে শায়খ ইবরাহিম আলী মুহাদ্দিসে কটারকােনি রাহ. ছিল অসাধারণ অবধান। বিশেষ করে বিদআত ও কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনে তিনি রেখে যান অসামান্য অবধান। যদ্দরুণ তিনি পরপারে চলে গেলেও আপন এলাকার মানুষের নিকট অমর হয়ে আছেন। যার জ্বলন্ত প্রমাণ! আজকের কুলাউড়া থানার কটারকােনা, হাশিমপুর, হাজিপুর ইউনিয়ন সহ আশে-পাশের এলাকা। দাওয়াতে তাবলিগের কাজেও তিনি তার জিবনের বৃহৎ একটি অংশ কাটিয়ে দেন। জিবন সন্ধ্যায় তিনি তাবলিগ জামাত বাংলাদেশের (কাকরাইল) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।
বাইয়াত ও খেলাফত. হযরত শায়খ ইবরাহিম আলী মুহাদ্দিসে কটারকােনি রাহ. তাঁর করাচি পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সাথি, বাংলাদেশ ক্বওমি শিক্ষা বাের্ডের মহামান্য ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। জামেয়া মাদানিয়া যাত্রাবাড়ি ঢাকা, স্বনামধন্য শায়খুল হাদিস ও মুহতামিম। মুহিউস সুন্নাহ, হযরত মাও. মাহমুদুল হাসান যাত্রাবাড়ি দা:বা: নিকট হতে তাসাউফের খেলাফত লাভ করেন। আর হযরত শায়খে যাত্রাবাড়ি দা: বা: হলেন, আরিফ বিল্লাহ, হযরত মাওলানা হাকিম আখতার সাহেব রাহ. আজল্লে খলিফা। মৃত্যু. শায়খুল হাদিস হযরত মাও.ইবরাহিম আলী মুহাদ্দিসে কটারকােনি রাহ. ১১ জুলাই ২০১৪ ইংরজি।
১২ রামাযান ১৪৩৫ হিজরী পবিত্র জুমআর দিন, হাজার হাজার ভক্ত মুরিদানদেরকে শােকের সাগরে ভাসিয়ে আপন রফিকে আলা’র সান্নিধ্যে চলে যান। পরদিন ১৩ রামাযান শনিবার দিন হাজার হাজার ভক্ত- মুরিদান, মুহিব্বিন, মুতাল্লিকিনদের উপস্হিতিতে তার জানাযার নামায সম্পন্ন হয়। তার জানাযার নামাজের ইমামতি করেন, তার ছােট ভাই,শায়খুল হাদিস আল্লামা শুয়াইব আলী সাহেব। দুয়া করি, মহান আল্লাহ তাআলা যেন জান্নাতুল ফেরদাউসের আলা মাকাম দান করেন। এবং আমাদেরকে তার পদাংক অনুসরণ করে চলার তাওফিক দান করেন। আমিন।