সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

মাওলানা ফজলুল করিম রহ. জীবন কর্ম ও অবদান

November 10 2018, 07:04

লিখেছেন- মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী>

 

মাওলানা ফজলুল করিম রহ. এর ৭১ বছরের কর্মময় ও সংগ্রামী জীবন এক বিস্ময়কর উপখ্যান। তিনি পথভোলা মানুষের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও নৈতিক সমৃদ্ধির সর্বাত্মক প্রচেষ্টা যেমন চালিয়েছেন তেমনি শিরক বিদআতের মোকাবেলা করেছেন। তিনি গণমানুষের মুক্তির জন্যে অধিকার আদায়ের জন্যে রাজপথে আন্দোলন ও সংগ্রাম করেছেন। আবার শিক্ষা সংস্কার তালিম তারবিয়াতেও আত্মনিয়োগ করেছেন।

এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ১৯৩৫ সাল মোতাবেক ১৩৫৪ হিজরীতে বরিশাল জিলার কোতোয়ালী থানার অন্তর্গত চরমোনাই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। আলিম ও বুযুর্গ পিতা-মাতার তত্ত¡াবধানে এবং দ্বীনী পরিবেশে তাঁর শিক্ষার হাতে খড়ি হয়। মাত্র ৫ বছর বয়সে তিনি নিজ গ্রামস্থ চরমোনাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাশাপাশি পিতা-মাতার যতেœ স্থানীয় মক্তবে পবিত্র কুরআন শিক্ষা শুরু করেন এবং চরমোনাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ১৯৪৫ সালে পিতার প্রতিষ্ঠিত চরমোনাই আহ্সানাবাদ রশীদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে তিনি ফাযিল পাস করেন। এখানে তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে উলে¬খযোগ্য ছিলেন মুফতীয়ে আ’যম হযরত মাওলানা আবদুল মুঈয বিহারী রহ.। অতঃপর ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ঢাকার লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ায় লালবাগ ভর্তি হন। লালবাগ মাদ্রাসায় দু’বছর অধ্যায়ন করে ১৯৫৭ সালে তিনি কৃতিত্বের সহিত দাওরায়ে হাদীস পাস করেন। দাওরায়ে হাদীসে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। হযরত পীর সাহেব রহ. লালবাগ মাদ্রাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুজাহিদে আ’যম হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ., আল¬¬ামা হেদায়াতুল¬¬াহ রহ., হযরত মাওলানা মুহাম্মদ উল¬¬াহ হাফেজ্জী হুজুর রহ., হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ ঢাকুবী হুজুর রহ., হযরত মাওলানা মুফতী আবদুল মুহীত সাহেব রহ., এবং শাইখুল হাদীস আল¬¬ামা হযরত মাওলানা আজিজুল হক সাহেব প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আলিমদের নিকট অধ্যয়ন করেন।

হযরত পীর সাহেব হুজুর রহ. যখন লালবাগ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন, তখন হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. দাওরায়ে হাদীস ক্লাসে বোখারী শরীফ এবং তিরমিযী শরীফ পড়াতেন। বার্ষিক পরীক্ষায় হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাঁর সঠিক উত্তর প্রদান ও চৌকষ লেখার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তিরমিযী শরীফে ১০০ না¤^ারের মধ্যে ১০৫ না¤^ার প্রদান করেন। উলে¬¬খ্য যে, খুব ভাল লিখলে কওমি মাদরাসায় পূর্ণমানের চেয়ে বেশী ন¤^র দেয়ার একটা প্রচলন তৎকালে বিদ্যমান ছিল।

শিক্ষকতা
১৯৫৭ ইং সালে হযরত পীর সাহেব চরমোনাই রহ. লালবাগ মাদ্রাসা হতে দাওরায়ে হাদীস পাস করার পর চরমোনাই আহ্সানাবাদ রশীদিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে নিয়োজিত হন। এ সময় থেকে একটানা বার বছর পর্যন্ত তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। হযরত পীর সাহেব হুজুর রহ. হাদীস, তাফসীর, ফিক্বহ, উসূল ইত্যাদি সব ধরণের কিতাবই পড়াতেন। তিনি “মাকামাতে হারিবী”ও অনায়াসে পড়াতেন, যাতে তার আরবী ভাষা ও সাহিত্যে দক্ষতা প্রস্ফুটিত হয়ে উঠত। কামিল জামায়াতে তিনি ইবনে মাজাহ শরীফের দরসে দিতেন। এছাড়া তিনি শামায়েলে তিরমিযীও নিয়মিত পড়াতেন। মাঝে মাঝে বুখারী শরীফের দরস দিতেন। এসব কিতাব ছাড়া মিশকাত শরীফ, হিদায়া, শরহে বিকায়া, নূরুল আনওয়ারসহ দরসী প্রায় সব কিতাবের তিনি পাঠদান করতেন।

অবদান
হযরত পীর সাহেব হুযুর রহ. এর অবদানে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-
১. বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ড
২. হিফয বিভাগ
এ বিভাগে দক্ষ হাফিযদের মাধ্যমে অল্প সময়ে পবিত্র কুরআন হিফয করানো হয়।
৩. ক্বিরাআত বিভাগ
সুদক্ষ ক্বারীর তত্ত¡াবধানে সহীহ্ ভাবে এবং ইলমে তাজবীদ সহকারে কুরআন তিলাওয়াত ও ক্বিরাআতে ছাবআ বা সাত ক্বিরাআত শিক্ষার আলাদা বিভাগ।
৪. তাখাচ্ছুছ বা অনার্স
হাদীস, তাফসীর ও ফিক্বহ শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জনের জন্য এ বিভাগ চালু করা হয়।
৫. মুজাহিদ প্রকাশনী
বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি কর্তৃক পরিচালত “মুজাহিদ প্রকাশনী” হযরত পীর সাহেব হুযুর রহ. এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ প্রকাশনী হতে আজ পর্যন্ত প্রায় ১৪০-১৫০ টি কিতাব প্রকাশিত হয়েছে। এসব কিতাবের মধ্যে রয়েছে কুরআন, হাদীস, ফিক্বহ, তাসাওউফ ও রাজনৈতিক বিষয়ের ওপরে লিখিত কিতাব।
৬. কুরআন শিক্ষা বোর্ড প্রকাশনা বিভাগ
কুরআন শিক্ষা বোর্ডের অধীনস্থ মাদ্রাসাসমূহের পাঠ্যপুস্তকে এ প্রকাশনা হতে প্রকাশ করা হয়।
৭. ইশা আন্দোলন প্রকাশনা বিভাগ
এ প্রকাশনা বিভাগ হতে আন্দোলন, সংগ্রাম ও ¯^াধীনতা সংক্রান্ত কিতাবাদি প্রকাশিত হয়।
৮. আল-ফাতাহ প্রকাশনী
এ প্রকাশনী থেকেও বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে লিখিত বই পুস্তক প্রকাশিত হয়।
৯. মারকাযুদ্দাওয়াহ ওয়াল ইফতা
দেশের শীর্ষস্থানীয় ফক্বীহদের সমš^য়ে এ বিভাগ চালু করা হয়েছে। সমসাময়িক কালের উদ্ভূত নতুন নতুন সমস্যার কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের আলোকে সমাধান পেশ করা তথা ফতোয়া ও মাসআলা প্রদান করা এ বিভাগের অন্যতম দায়িত্ব। এ বিভাগ হতে ইতোমধ্যে দেশে প্রচলিত নেটওয়ার্ক বিজনেসের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট ফতোয়া প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়াও বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা থেকে হযরত পীর সাহেব রহ. এর বয়ান, ভাষণ, ওয়ায-নসীহতসমূহ পুস্তক আকারে বের হয়েছে, যা মানুষের জন্য হেদায়েতের আলোক বর্তিকা ¯^রূপ।
গ্রন্থরাজির মধ্যে উলে¬¬খযোগ্য হল-
১) মাওয়ায়েযে কারীমিয়া (১ম থেকে ৪র্থ খন্ড পর্যন্ত) এ সব কিতাবে চরমোনাই মাহফিলে পীর সাহেব হুযূরের বয়ানসমূহ সংকলিত হয়েছে।
২) মানুষ হওয়ার উপায়-এটি বিভিন্ন রমযানের তারবিয়াতের বয়ানের কিতাব, যা তাসাউফ ও মা’রিফাতের ¯^রূপ।
৩) কুয়েতের ভাষণ- ২৫/০৯/৯৭ ইং তারিখে কুয়েত সিটিতে হযরত পীর সাহেব রহ. ওলামায়ে কেরামের সম্মেলনে যে ঐতিহাসিক ভাষণ পেশ করেন তা সংকলিত হয়েছে।
৪) চরমোনাইর হযরত পীর হুযূরের ঐতিহাসিক ভাষণৎ ৩০ ডিসে¤^র’ ৯৪ বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে স্মরণকালের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে ভাষন পেশ করেন, তা এতে সংকলিত হয়েছে।
৫) চরমোনাইর পীর সাহেব হুযূরের কুয়েতের পাঁচ দিন ।
৬) চরমোনাইর পীর সাহেব হুযূরের ভারত সফর।

বাইয়াত গ্রহণ ও খেলাফত লাভ
হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. ছাত্র জীবনেই ¯^ীয় পিতা ও শাইখ হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. এর নিকট তরীকতের বাইয়াত গ্রহণ করেন। জাহেরী ইল্মের পাশাপাশি তিনি বাতেনী ইল্মও অর্জন করেন।

শাইখের স্থলাভিষিক্ত
হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. পিতা ও শাইখ হতে তরীকতের খেলাফত লাভ করলেও শাইখ কর্তৃক স্থলাভিষিক্ত নির্ধারিত হননি। সৈয়ধ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. অন্য কাউকেও স্থলাভিষিক্ত করে যাননি বরং তিনি এ জন্য তার খলীফাদের মধ্য থেকে ১২ জনকে নিয়ে একটি শূরা কমিটি গঠন করেন এবং এ কমিটিকে অসিয়ত করেন যে, তাঁর ইন্তিকালের পর শূরা কমিটি তাঁর খোলাফাদের মধ্য থেকে যাঁকে অধিক মুত্তাক্বী, আমলদার ও যোগ্যতা সম্পন্ন মনে করবে তাঁকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নির্বাচন করবে। মাওলানা সৈয়দ ইসহাক রহ. এর ইন্তিকালের পর ১৯৭৩ ইং সালে শূরা কমিটি অসিয়ত অনুযায়ী তাঁর দ্বিতীয় সাহেবজাদা ও খলীফা মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম রহ. কে তাক্বওয়া, আমল ও যোগ্যতার দিক দিয়ে অগ্রগামী সাব্যস্ত করে তাঁকে শাইখের স্থলাভিষিক্ত নির্বাচিত করেন।

বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি গঠন
হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিম রহ. এর আব্বাজান হাদীয়ে যমান হযরত মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক (পীর সাহেব চরমোনাই) রহ. তরীকার খিদমত সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য “বাংলাদেশ মুজাহিদ কমিটি” গঠন করেন। যেহেতু তাঁর তরীকতের দীক্ষায় অনুসারী ও মুরীদদের আত্মশুদ্ধির বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, সে মতে তাদেরকে সর্বদা নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত থাকতে উৎসাহিত করেন। এজন্য সৈয়দ মুহাম্মদ ইসহাক রহ. তাঁর মুরীদদের নাম রাখেন মুজাহিদ। এ নামকরণের আরো একটি কারণ হল, তার মুরীদগণ নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ করে যেমন নফসকে পরিশুদ্ধ ও নির্মল করবে, তেমনি তারা সমাজ ও দেশ থেকেও অন্যায় ও বাতিলকে উৎখাত করে সেখানে ইসলামী হুকুমাত কায়েম করা তথা সমাজকে নির্মল ও পরিশুদ্ধ করতেও মুজাহিদের ভূমিকা পালন করবে। মুজাহিদ কমিটির যিনি নেতৃত্ব দিবেন তিনি হবেন আমীরুল মুজাহিদীন। পরবর্তিতে মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করিম রহ. এর নেতৃত্বে এ কমিটি বাংলাদেশের সর্বত্র এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে ইসলামের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি পৌঁছে দিচ্ছেন। বিশেষ করে এই মুজাহিদরা তাদের আত্মশুদ্ধির জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।

ইন্তেকাল
শাহসূফী সৈয়দ মুহাম্মদ ফজলুল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) রহ. এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ২০০৩ সাল ২৫ নভেম্বর মোতাবেক ১১ অগ্রহায়ন রোজ শনিবার বেলা সকাল সাড়ে নয়টায় ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি …আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন এবং তার রেখে যাওয়া পরিবার-পরিজন ও কোটি কোটি মুরিদ ভক্তদের কবুল করুন। আমিন।

Spread the love