মাওলানা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রহ.’র সংক্ষিপ্ত জীবনী
November 25 2020, 04:51
কুতবুল আলম, শায়খুল আরবে ওয়াল আজম, আল্লামা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.’র যেসকল খলীফা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আমরণ দেশ ও জাতির খেদমত আঞ্জাম দিয়ে গেছেন, তাদের অন্যতম হলেন, শায়খুত তাফসীর আল্লামা বদরুল আলম ( শায়খে রেঙ্গা) রহমাতুল্লাহি আলাইহি। যিনি একনিষ্ট মেহনত, মোজাহাদা করে এতদঞ্ছলে ছড়িয়ে থাকা শিরক,বেদাতের অন্ধকার দূরীভুত করতে কুরআন-সুন্নাহের সঠিক আলোর এমন মশাল জালিয়ে দিয়েছেন, যা অনন্তকাল আলো ছড়াতেই থাকবে ইনশাআল্লাহ। যার সুহবতে এসে অসংখ্য পথ ভুলা মানুষ পথের দিশা পেয়ে আজও দীনের খেদমতে ঠিকে আছেন অটল অবিচল হয়ে। পরশপাথর তুল্য এই মহান মনীষিকে “শায়খে রেঙ্গা” নামে সবাই স্বশ্রদ্ধ স্বরণ করে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
★ জন্ম ও বংশঃ ১৩১৯ বাংলার ১ লা বৈশাখ / ১৯১২ ঈসায়ী সনের ১৪ এপ্রিল, রোজ রবিবার, আল্লামা বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা রহ. সিলেটের দক্ষিণসুরমা উপজেলার রেঙ্গা পরগনায় হরিনাথপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শায়খ আরকান আলী এবং মাতার নাম আবিদা খাতুন। তাঁর পিতা তৎকালীন সিলেটের অন্যতম আলেম, প্রচারবিমুখ বুযুর্গ এবং ঐতিহ্যবাহী জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
★ শিক্ষা দীক্ষাঃ হযরত শায়খ বদরুল আলম রহ. সর্বপ্রথম তাঁর পিতার নিকট কুরআন শরীফ শিক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা করেন। অতপর ১৯১৯ সালে পার্শবর্তী কান্দিগ্রাম স্কুলে লেখা পড়া করেন। ১৯২০ সালে ভর্তি হন তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায়। এখানে হেদায়াতুন নাহু পর্যন্ত পড়েন।
১৯৩০ সালে ভর্তি হন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় এবং সেখান থেকেই তিনি কামিল পাশ করেন। ১৯৩৬ সালে সিলেট সরকারি আলিয়ার পড়াশোনা শেষ করে আরো উচ্চতর ইলমের তামান্না নিয়ে ভর্তি হন বিশ্ববিখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ, দারুল উলূম দেওবন্দ মাদ্রাসায়। সেখান থেকে প্রথমে দাওরায়ে হাদীস অতপর তাখাসসুস ফিত তাফসীর সমাপ্ত করেন।
★ খেলাফত ও ইজাযত লাভঃ হযরত শায়খে রেঙ্গা রহ. দেওবন্দ থাকাকালীন ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে শায়খুল ইসলাম, আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.’ র কাছে বায়াত হন। অতপর, হযরত মাদানী রহ. নির্দেশনা মোতাবেক রিয়াজত ও মোজাহাদায় আত্মনিয়োগ করেন। আত্মভোলা হয়ে ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়ে পড়েন। তাহাজ্জুদ, ইশরাক্ব, তেলাওয়াত ইত্যাদি আদায়ের সাথে সাথে দৈনিক সোয়া লক্ষ বার করে ইসমে জাতের জিকিরও আদায় করতে থাকেন। আর এভাবেই সুলূকের উচ্চাঙ্গে আরোহন করার পর হযরত মাদানী রহ. পক্ষ থেকে খেলাফত ও ইজাযত লাভ করেন।
★ শিক্ষকতা,দাওয়াত ও জনসেবাঃ দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা সমাপনীর পর দেশে ফিরে তিনটি মিশনের উপর তিনি কাজ করতে থাকেন। এক, তা’লীম,তাআল্লুম তথা শিক্ষা দীক্ষা প্রদান। দুই, সর্বসাধারণের মাঝে দাওয়াতের লক্ষ্যে ওয়াজ ও তাফসীরের প্রসার। তিন, তাযকিয়ায়ে নাফস তথা আত্মশুদ্ধির মেহনত । হযরত শায়খে রেঙ্গা রহ. তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত জামেয়া রেঙ্গায় প্রথমে শিক্ষক নিযুক্ত হয়ে পর্যায়ক্রমে মুহতামিমের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
তৎপর তাঁর দক্ষতা, দূরদর্শীতা ও আন্তরিক মেহনতের ফলে এ জামেয়া উন্নতির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে যায়। জামেয়ার উন্নতি অগ্রগতির আসল রুপকার হলেন হযরত শায়খে রেঙ্গা রহ.। মাদরাসা পরিচালনা, শিক্ষকতা ও বিভিন্ন সামাজিক খেদমতের পাশাপাশি তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ও নিয়মিত মিশন ছিলো ” তাফসীরুল কুরআন “। তিনি সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বৃহত্তর রেঙ্গা এলাকা, সিলেট সদর, ফেঞ্ছুগঞ্জ, বালাগঞ্জ, ওসমানী নগর ইত্যাদি এলাকায় নিয়মিত সাপ্তাহিক তাফসীর করতেন।
★ সন্তান সন্তুতিঃ হযরত শায়খে রেঙ্গা রহ. পর্যায়ক্রমে চারটি বিবাহ করেন। তাঁর কনিষ্ঠ স্ত্রী এখনও জীবিত আছেন। তিনি তিন স্ত্রীর গর্ভে সন্তান লাভ করেছিলেন এবং মোট ২৩ জন সন্তান লাভ করেন। যাদের অনেকেই শিশুকালে মৃত্যু বরন করেন। আর যারা জীবিত আছেন, তাদের সবাইকে তিনি আলেম হাফেজ ও সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, তাঁর এতো সন্তানের মাঝে একজনও বদ্দীন কিংবা বিপথগামীতায় ধাবিত হননি। সবাইকে তিনি আল্লাহওয়ালা, আদর্শ এবং দেশ ও জাতির দরদী হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যা একজন আদর্শ ও সফল পিতা হওয়ার জলন্ত প্রমাণ বহন করে। হযরত শায়খ রহ. সর্বক্ষেত্রেই এভাবে সফলতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাঁর সুযোগ্য সন্তান আল্লামা শায়খ শামসুল ইসলাম খলীল বর্তমানে জামেয়া রেঙ্গার সরপরস্ত এবং আরেক সন্তান হযরত শায়খ মুহিউল ইসলাম বুরহান মুহতামিম হিসেবে দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।
★ খুলাফাঃ আত্মশুদ্ধির মেহনতে হযরতের কাছে দেশ বিদেশের অসংখ্য আলেম, হাফেজ, সর্বসধারণ বায়আত হন। যাদের মধ্যে বিশ্ববরেণ্য অনেক উলামায়ে কেরাম রয়েছেন যারা শায়খে রেঙ্গা রহ.’র খেলাফত লাভে ধন্য হন। তাদের কয়েকজন হলেন ; শায়খুল হাদীস আল্লামা কমর উদ্দিন রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল বারী রহ.শাহাদতপুরী, শায়খ সিকান্দর আলী রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা তাফাজ্জুল হক রহ. হবিগঞ্জী, শায়খ ফখরুদ্দীন রহ.গলমুকাপনী, মুফতি আব্দুল গনী রহ., হযরত মাওলানা জিয়াউর রহমান রহ. প্রমুখ।
★ ইন্তেকাল ও জানাজাঃ ১১রজব,১৪০৫ হিজরী / ২রা এপ্রিল, ১৯৮৫ ঈসায়ী, রোজ মঙ্গলবার, দুপুর ১২ টা ১০ শে, আল্লাহ আল্লাহ বলতে বলতে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। তাঁর ইন্তেকালের খবর শুনে অসংখ্য মুরিদীন, মুহিব্বীন, আত্মীয় স্বজন সহ সর্বসাধারণের মাঝে শোকের মাতম শুরু হয়। চতুর্দিক থেকে ছুটে আসতে থাকেন হাজার হাজার উলামায়ে কেরাম,তালাবায়ে এজাম ও মুসলিম জনসাধারণ।
জামেয়া রেঙ্গার ময়দানে তৎকালীন সময়ের সর্ববৃহৎ জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর জানাজার নামাজে ইমামতি করেন তাঁরই সুযোগ্য সন্তান হযরত মাওলানা শামসুল ইসলাম খলীল সাহেব দা.বা.। অতপর উপমহাদেশের এই মহান বুযুর্গকে জামেয়ার মাঠের দক্ষিণ পাশে দাফন করা হয়। আল্লাহ পাক তাঁর কবরকে জান্নাতের নূর দ্বারা ভরপুর করে দিন। আমীন।
লেখক, মাওলানা আহমদ কবীর খলীল। শিক্ষক, জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা, সিলেট।