মাওলানা শায়খ আনওয়ারুলহক চৌধুরী রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
June 22 2020, 04:34
নাম :- মুহিউস সুন্নাহ শায়েখ আনওয়ারুলহক চৌধুরী রহ
জন্মস্থান :- সিলেট জেলার বালাগঞ্জ থানাধীন দেওয়ান বাজার ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী মুসলিম জমিদার পরিবারের মডেল পুরুষ। মৌলভীবাজার জেলার বুদ্ধিমন্তপুর গ্রামে নানার বাড়িতে ২০নভেম্বর ১৯৩৫সালে জন্মলাভ করেন।
শৈশব কাল :- হযরতের নানা সৈয়দ আব্দুর রউফ চৌধুরী ছিলেন মৌলভীবাজারের বুদ্ধিমন্তপুর গ্রামের সনামধন্য প্রতাপশালী জমিদার। হযরতের সম্মানিতা মাতা ছিলেন জমিদার সাহেবের একমাত্র কন্যা। কন্যাকে বিবাহ দিয়ে জমিদার সাহেব পতিত হন সন্তান-বিচ্ছেদের বিরহ জালায়। সেই জালা সইতে তিনি ছিলেন একেবারে অক্ষম। তাই কন্যা ও জামাতা উভয়কেই নিজ বাড়িতে রাখতে চাইলেন। সুতরাং মাতা-পিতার সঙ্গে শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.)-র শৈশবের প্রথম কয়েকটি বৎসর কাটলো নানার বাড়িতেই। সেখানেই তাঁর শুরু হয় শিক্ষার সূচনা।
শিক্ষা জীবন :- তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি বলেন,__ \” নানার বাড়িতেই মা-বাবা ও নানির কাছে আমার আলিফ, বা, তা, ছা পড়া শুরু হয়। সেখানে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে তিনি ভর্তি হন, এবং এক এক করে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত সে স্কুলে লেখা-পড়া করেন।
অতঃপর চলে আসেন নিজ বাড়ি সুলতানপুরে। যেহেতু তাঁরা জমিদার বংশের মানুষ, অপরদিকে ধর্মানুরাগীও তাই আশপাশ বহু এলাকা জুড়ে তাঁদের বাড়িই ছিলো তখন ধর্মীয় শিক্ষার কেন্দ্র। বাড়িতে একটি মাদরাসা মাধ্যমিক পর্যন্ত ছিলো। বরেণ্য শায়খুল হাদীস আল্লামা নূরুদ্দীন গহরপুরী (রহ.) এ মাদরাসাতেই প্রাথমিক লেখাপড়া সমাপ্ত করেছিলেন। শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.) নানার বাড়ি থেকে এসে বাড়ির মাদরাসাতে ভর্তি হয়ে লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। বিশিষ্ট বুযুর্গ হযরত আব্বাস আলী খাপুরী (রহ.) এ মাদরাসারই শিক্ষক ছিলেন। শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.) এখানে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
হযরতের দাদা ছিলেন সর্বজন স্বীকৃত কামেল ওলী। বাড়িতে থাকাকালীন তিনি দাদার সুহবত হাসিল করেন।
এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের ১লা মার্চ ভর্তি হন তৎকালীন বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায়। তখনকার সময়ে এ মাদরাসায় দরসে নেযামীর কিতাবগুলো বুযুর্গ আলেমদের দ্বারা পড়ানো হত।
১৯৫৯ সালে কামিল ( তাকমীল ফিল হাদীসের) পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে সেখান থেকে ফারেগ হন তিনি।
এদিকে ১৯৫৮ সালে প্রাইভেট হাই মাদরাসা থেকে সমাপনী পরীক্ষাও তিনি দিয়েছিলেন ।
সিলেট আলিয়ায় থাকাকালীন প্রথমে তিনি ছিলেন সিলেট তিব্বি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা, চাচা মৌলভী হেকীম বশীরুল হক চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে। তারপর চলে আসেন তাঁর বড় চাচা ফখরুল মুহাদ্দিসীন শায়খুল হাদীস আল্লামা লুৎফুল হক সাহেবের অধীনে। লুৎফুল হক ছিলেন সরকারি আলিয়ার প্রিন্সিপাল ও মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডের রেজিষ্টারার। তিনি যে একজন কামেল-মুকাম্মাল ওলী ছিলেন সকলের কাছে ছিলো তা স্পষ্ট। এ কামেল বুযুর্গের সুহবাতও শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.) পেয়েছিলেন পুরোপুরি।
কর্ম জীবন :- আলিয়া মাদ্রাসা যেহেতু সরকারি ব্যবস্থাধীনে, তাই আলিয়ার এমন কতগুলো কার্যক্রম আছে যেগুলোকে শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.) ঘৃণা করতেন মনে-প্রাণে। তাই সরকারি চাকরির কোন চিন্তাই তিনি করেননি। অপরদিকে বহুদূর পর্যন্ত কোন ক্বওমী মাদরাসায়ও ছিলো না। অতএব, লেখা-পড়া সমাপ্তির পর কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। শুরু হলো তেপান্তরের জীবনযাপন। বিজন প্রান্তরে দিশেহারার মতো তিনিও যেন পড়ে গেলেন বহুমুখী এক চত্তরে। জীবনের এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রতিটি যুবকেরই থাকে সৃজনধর্মী চিন্তাধারা। ধন-ঐশ্বর্য যোগাবে, মান-মর্যাদা কুড়াবে, বিলাসবহুল বাড়ি আর পরানকাড়া নারী নিয়ে শুরু করবে সংসার যাত্রা। আরো কত কি। শায়খ আনওয়ারুল হক চৌধুরীর হৃদয়েও সুপ্ত ছিল এমনই এক সৃজনধর্মী চেতনা। তবে তা অন্যদের চেয়ে বিলকুল ভিন্ন। এ চিন্তার বিজ বংশ সূত্রেই ছিল তাঁর মন ও মস্তিষ্কে রোপিত।
আর তা হলো, সমাজ সংস্কারে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের এক জীবন্ত লক্ষ্য। এ চিন্তা ও কার্য তার পূর্বপুরুষ বীর সিপাহসালার হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামেনী (রহ.)-র সুযোগ্য সাথী হযরত আলাউদ্দিন সিদ্দিকী (রহ.) থেকে নিয়ে পিতা নূরুল হক ওরফে ওলী মিয়া চৌধুরী (রাহিমাহুল্লাহ) পর্যন্ত প্রায় সকলেরই অন্তরে ছিল। ___এজন্যই তো শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রাহিমাহুল্লাহ)-র পিতা নূরুল হক ওরফে ওলী মিয়া চৌধুরী আপন শশুরবাড়ির এলাকায় একটি দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে গিয়ে ছিলেন।
এ মুহূর্তে শায়খ আনোয়ারুল হক (রহ.)-র মধ্যেও সেই চেতনা নাড়া জাগালো ভেতর থেকে প্রবল ভাবে। কিন্তু এ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ একাধিক বিষয় এসে ভিড় ধরলো স্মৃতিপটে।
প্রথমতঃ ইলম তো অর্জন হয়েছেই তবে অন্ধকার সমাজে আলো জ্বালাতে হলে হৃদয়কে আগে আলোকিত করে নিতে হবে। সেইসাথে প্রয়োজন জনমতের। তাছাড়া যাপিত জীবনের জন্য প্রয়োজন কামাই-রুজিরও। এবার সমশক্তিশালী গুরুত্বপূর্ণ দু\’টো প্রয়োজন মনকে করে তুলেছে দ্বন্দ্বমুখর। কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। পরামর্শ চাইতে গেলেন আপন চাচা বিশিষ্ট বুযুর্গ লুৎফুল হক চৌধুরী সাহেবের কাছে। তিনি ছিলেন তাঁর সর্ব বিষয়ের মুশীর। তিনি এমন এক পরামর্শ দিলেন, পরবর্তীতে দেখা গেলো এ পরামর্শ গ্রহণ করায় সকল উদ্দেশ্য এ পথ ধরেই সাধিত হলো অনায়াসে। চাচার পরামর্শ মতে তিনি কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। সিলেট জিন্দাবাজারে ছিলো \”হক্বানী ষ্টোর\” নামে তাঁর কাপড়ের দোকান। তখন শুরু হয়ে গেলো বড় বড় বুযুর্গদের সাথে সান্নিধ্যের সুযোগ। হালাল উপায়ে কেনাকাটা করতে আলেম-ওলামাগণ এ দোকানে আসতেন। সেই সুযোগে তিনি উলামায়ে কেরামের পরামর্শ ও সুহবতে নিজের হৃদয়কে উজালা করতে লাগলেন। এ ব্যাপারে তিনি আত্মজীবনীতে বলেন,___ \” চাচা লুৎফুল হক চৌধুরী আমাকে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহ দিতে লাগলেন। মূলধনও তিনি যোগাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন। তাই আল্লাহর উপর ভরসা করে \”হক্বানী ষ্টোর\” নামে একটি কাপড়ের দোকান শুরু করি।
মোটামুটি সফলতা অর্জন হতে লাগলো। দেশের ওলামায়েকেরাম শহরে এলেই আমার এখানে সময় কাটাতেন। তাঁদের সুহবতের ফয়েজ পেতে লাগলাম। সিলেট শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা প্রায়সই আমার দোকানে এসে বসতেন। উপদেশবাণী শুনাতেন। তাঁরা সবাই ছিলেন বয়স্ক আর আমি ছিলাম অল্পবয়স্ক। তাঁদের স্নেহ-মমতায় ধন্য হতে লাগলাম। বিশেষতঃ চতুল নিবাসী এক কামিল বুজুর্গ মাওলানা ইসমাইল চতুলী (রহ.)-র সুহবত আমার উপর বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলো। তাঁরই ওসীলায় দাওয়াত ও তাবলীগের সাথে পরিচিত হই। এ সময়েই পাকিস্তানের এলাহাবাদের একজন কামিল বুযুর্গ হযরত শাহ মাশহুদ দরগায়ে হযরত শাহজালাল এসেছিলেন। তিনি দশদিন যাবৎ এখানে অবস্থান করেন। সেই দশদিনে উনার সুহবতে থাকার সুযোগে রুহানী তরক্বির যা স্বাদ পেয়েছিলাম তাই আমার দুনিয়ার মোহ থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণ হয়।\” তিনি একাধারে কয়েক বৎসর ব্যবসা করেন। তাঁর ব্যবসা ছিল সম্পূর্ণ শরীয়তভিত্তিক। শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুশ শহীদ চাম্পারকান্দী হুজুর দাঃ বাঃ তাঁর ব্যবসার ধরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,__\”তিনি হলেন সুন্নতের পাবন্দ ।
ফারেগ হওয়ার পর তিনি কিছুদিন কাপড়ের দোকান দিয়েছিলেন। এ সময় তাঁর ব্যবসাও ছিলো সুন্নাত অনুযায়ী।\” সেই সময় কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিতাবাদির অধ্যয়নও অবিরত রাখেন। বিশেষ করে হাকীমুল উম্মাত আল্লামা আশরাফ আলী তানভীর (রহ.)-র লিখিত কিতাবাদি তিনি বেশি বেশি অধ্যয়ন করতেন। তাই থানভী (রহ.)-র প্রতিচ্ছবি তাঁর যাপিত জীবনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হযরত হরমুযুল্লাহ (রহ.)-র হজ্জের সফর সঙ্গী হয়ে কয়েক মাস উনার রূহানী তাজাল্লি লাভ করায় হরমুযুল্লাহ সাহেবের আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের অসাধারণ কারামাতও হযরত শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.)-র জীবনে কার্যকরি ভূমিকা পালন করে।
এরপর ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তিনি হযরত শাহ জালাল (রহ.) দরগা জামে মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। হযরতের উপর ইমামতির দায়িত্ব অর্পণের জন্য যখন দরগার মুতাওয়াল্লি সাহেব হযরতকে খবর করে বিষয়টি বলে দিলেন, তখন হযরত ইমামতির দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালে মুতাওয়াল্লি সাহেব বললেন, \” আমি তা জানি না। আপনার উপর দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। এটা শুধু আমি জানিয়ে দিলাম।\” হযরত তখন দরগা মসজিদের মুতাওয়াল্লি এডভোকেট মুফতি ফখরুদ্দীন সাহেবের কাছে নিজের অসম্মতির বিষয়টি তুলে ধরলে তিনি বললেন , \”দরগা মসজিদে এখন কে ইমামতি করবেন সে ব্যাপারে ইস্তেখারা করার জন্য সিলেটের প্রসিদ্ধ বুযুর্গ হযরত মাওলানা রমিয উদ্দীন সাহেবকে আরজ করা হয়েছিলো। উনিই ইস্তেখারা করে আপনার নাম ঘোষণা করেছেন।\”
যাইহোক, এরপর থেকে তিনি একাধারে কয়েক বৎসর দরগা জামে মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। এসময় ফজর ও আসরের পর তিনি তা\’লীমের রীতি চালু করেন এবং নিজেই মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে তা\’লীম দিতেন।
অবদান :- দরগা মসজিদে ইমামতির দায়িত্ব পালনকালে তিনি সমাজে ধর্মীয় অধঃপতন ও তার সংস্কারকরণ নিয়ে ভাবতে লাগলেন। ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে তিনি এমন এক সমাধানে উপনীত হলেন, যা বাস্তবতার মাপকাঠিতে শতভাগ উপযুক্ত। তিনি সমাধান খুঁজে পেলেন, \” পরিবেশ তৈরী হয় মেয়েদের মাধ্যমে। তাই দ্বীনী পরিবেশ তৈরী করতে হলে মেয়েদেরকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।\”
সুতরাং ১৯৮২ সনে প্রতিষ্ঠা করেন \”আল- জামেয়াতুত্ত্বায়্যিবাহ সুলতানপুর মহিলা মাদরাসা\”। পাশাপাশি নিজের বাড়িতে চালু করেন মহিলাদের তা\’লীমী মজলিস। তিনি বিশ্বাস করতেন \” মা হলেন, প্রথম মাদরাসা।\” \”মায়েদের উসীলায়ই সন্তানরা জাহান্নাম থেকে মুক্তিলাভ করে।\” \” যদি একজন মহিলা আল্লাহ ওয়ালী হয়ে যায় তবে সত্তরজন পুরুষ আল্লাহ ওয়ালার চেয়ে উত্তম।\” তাই সমাজ সংস্কারের কাজে তিনি এমন স্থানে হাত দিলেন যা হলো একেবারে গোঁড়া এবং উৎপাদনস্থল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই কেন্দ্রে জোর চালালেই ইনশাআল্লাহ মিশন ফতেহ হবে। সুশিক্ষিত মায়ের কাঙ্গাল সকল কালের জ্ঞানী-গুণীরাই ছিলেন। তাই তো বিজ্ঞানী বলেছিলেন,__\” আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।\”
হযরত শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.)-র হৃদয়ে যেন ওই সব শিক্ষিত মায়ের কাঙ্গাল মনীষীদের প্রাণের হাহাকার নতুন শক্তি নিয়ে জেগে উঠেছিলো।
নারী অধঃপতনের প্রবহমাণকালের যে সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি মহিলা মাদরাসা করার চিন্তা করছিলেন তখন মহিলা মাদরাসা হবে তো দূরের কথা, মুসলিম উম্মাহের কর্ণধারদের মধ্যে মহিলা মাদরাসা জায়েজ কি না , এ নিয়ে চলছিলো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। তিনি সকল দ্বিধাকে তুচ্ছ করে এক পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন আপন উদ্দেশ্যের দিকে অতি সন্তর্পণে। তখনকার সময় মহিলা মাদরাসাতে পড়ানোর মতো একজন মহিলাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু বর্তমানে হাজার হাজার মহিলা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। এসবই একমাত্র হযরত শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ .) মেহনতের ফসল(الفضل للمتقدم) । তাঁর এ চিন্তাধারাকে আমি বলবো, মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে এলহাম। বর্তমান যামানার প্রায় সকল আলেমই হযরতের এ চিন্তাধারাকে শুধু সমর্থনই নয় বরং নিজেরাই মহিলা মাদরাসার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে স্থানে স্থানে মহিলা মাদরাসা খুলে বসেছেন।
তাঁর এ চিন্তাধারা ও কর্মকৌশলের সার্থক ফলস্রুতিতে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ বলে উনাকে আখ্যায়িত করা অত্যুক্তি নয়।
মহিলাদের জন্য মাদরাসা করেই ক্ষান্ত নন তিনি। পুরুষদের জন্যও প্রতিষ্ঠা করেন, \” হযরত শাহ সুলতান (রহ.) মাদরাসা\”। সেই সাথে সর্বসাধারণের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন, \” তাহরীকে এ\’লায়ে কালিমাতুল্লাহ\” নামক একটি বহুমুখী দ্বীনী সংগঠন।
তিনি ধর্মীয় সংস্কারমূলক কাজে তৎকালীন বরেণ্য আলেম ও চিন্তাবিদদের থেকে সময়ে সময়ে পরামর্শও নিতেন। তখনকার সময়ে যেহেতু যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে চিঠি-পত্র ব্যবহৃত হত তাই তিনি পরামর্শ চাওয়ার মাধ্যম হিসেবে চিঠিকেই ব্যবহার করতেন। ওলামায়ে কেরামগণ ওইসব চিঠির পাল্টা জবাবও সানন্দে এবং অতি উৎসাহের সাথে রিটার্ন করতেন। জবাবি চিঠিগুলোর মধ্য থেকে একটি চিঠি এখানে তুলে ধরছি। পাঠিয়েছেন, \”বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ
বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড\” এর সম্মানিত মহা-সচিব মাওলানা আব্দুল জব্বার (রহ.)। যা ৩/৮/ ৯৮ সনে পাঠানো হয়েছে। আজও তা সংরক্ষিত আছে।
\”মুহতারাম,
হযরত মাওলানা আনোয়ারুল হক চৌধুরী সাহেব
زيد مجدكم
পরিচালক তাহরীকে এলায়ে কালিমাতুল্লাহ সিলেট।
السلام عليكم و رحمة الله و بركاته
আপনার প্রেরিত কর্মসূচি অবগত হয়েছি। পড়ে খুশী হলাম। দু\’আ করি,__ আল্লাহপাক আপনার মেহনতকে কবুল করুন। আমীন!
আমার একটু পরামর্শ হচ্ছে , মসজিদ কেন্দ্রিক মক্তবগুলোর শিক্ষার উন্নয়ন লক্ষ্যে উহার শিক্ষকবৃন্দকে প্রশিক্ষণ দেয়ার একটা ব্যবস্থা করা হোক।
আরো একটি পরামর্শ হচ্ছে, পাঁচ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হোক।\”
তিনি যেভাবে বড়দের থেকে ধর্মীয় সংস্কার কাজে পরামর্শ নিতেন এরূপ অন্যান্য বড় বড় ইসলামিক চিন্তাবিদগণও ধর্মীয় সংস্কার কাজে তাঁর কাছে পরামর্শ চাইতেন।
পরামর্শ চেয়ে পাঠানো এমনি একটি চিঠি হুবহু তুলে ধরছি, তা পাঠিয়েছেন__ মুসলিম জাহান এবং তাফসীরে মা\’আরেফুল কোরআনের অনুবাদক ও সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.)
السلام عليكم و رحمة الله\”
মোহতারাম হযরত মাওলানা সাহেব!
পত্র পেয়েছি। তৎসঙ্গে দারুল উলূম দেওবন্দের ফতওয়াও পেয়ে উপকৃত হয়েছি। আল্লাহপাক আপনাকে জাযা দান করুন।
আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি।
সাপ্তাহিক মুসলিমজাহান এবং বর্তমান কলেবর সেই চেষ্টারই একটা ক্ষুদ্র অংশ।
দোয়া এবং সহযোগিতা চাই।
আল্লাহপাক আমাদের উপর আপনাদের ন্যায় হিতাকাঙ্ক্ষীগণের ছায়া দীর্ঘতর করুন।\”
শায়েখ আনোয়ারুল হক চৌধুরী (রহ.)-র সমস্ত দ্বীনী কাজ সার্থকভাবে সফল হয়েছে। বিশেষত নারীদের জন্য তিনি যে মাদরাসা কায়েম করে গেছেন তা সকল মহিলা মাদরাসার আদর্শ। দেশে বিদেশে এর বহু শাখা রয়েছে। সুলতানপুরের ছাত্রীদের এমনও অনেক কাহিনী আছে যা নিশ্চয় প্রশংসনীয়। তাঁদের অনেকেই নিজ এলাকায় মহিলা তা\’লীম চালু করে পুরো এলাকা আবাদ করে নিয়েছেন। আমার জানা এমন অনেক ঘটনা আছে।
সুলতানপুর মহিলা এবং পুরুষ উভয় মাদ্রাসার অধীনে বহু মাদরাসা আছে যেগুলোর বেতনসহ পরিচালনা করা হচ্ছে।
হযরত শায়েখে সুলতানপুরী (রহ.) দানশীলতার ক্ষেত্রেও বিরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আমার জানা মতো অনেক পরিবার আছে তারা হযরতের দানের উপরই জীবন চালিয়ে যাচ্ছিলো। তাদের সন্তানাদির বিবাহ-শাদি থেকে নিয়ে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ কাজে তিনিই তাদের অভিভাবক হয়ে কার্য সমাধান করেছেন।
তিনি আঞ্জুমানে তা\’লীমুল কোরআন বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা হিসেবে আমরণ দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তিনি একজন খাঁটি আশেকে রাসূল ছিলেন। রাসূল (সা.)-র ছোট্ট থেকে ছোট্ট সুন্নাতও তিনি গুরুত্বের সাথে আমল করতেন এবং অন্যান্যদেরকে এর উপর আমল করতে উৎসাহিত করতেন। রাসূল (সা.)-র ওইসব সুন্নাত যেগুলো মানুষ অবহেলাবশত ছেড়ে দেওয়ায় তা আজ মৃতপ্রায় হয়ে গেছে, তিনি সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করে আমলে পরিণতকরণের মাধ্যমে যেহেতু জিন্দা করে তুলেন তাই উনাকে \”মুহিউসসুন্নাহ\” বলা হয়।
হযরতের হৃদয়টা রাসূলপ্রেমে ভর্তি ছিলো। দেখতাম, রাসূল (সা.)-র আলোচনা শুনলেই তিনি কেঁদে উঠতেন। মাঝেমধ্যে তো এমন হতো, তিনি লাগাতার রাসূল (সা.)-র জীবনের খণ্ড অংশগুলো আলোচনা করতেন আর আওয়াজ করে কাদঁতেন।
মৃত্যু তারিখ :- যেহেতু অসুস্থতায় হুজুর আল্লাহর নাম অতিমাত্রায় স্মরণ করতেন, তাই তিনি মৃত্যুর পূর্বে প্রথম যেদিন অশান্তি অনুভব করেন সে দিন থেকে তাঁর মুখ দিয়ে এ আয়াতটি উচ্চারিত হতে লাগলো, __ \”ذالك بأن الله مولى الذين امنوا\” অর্থাৎ \’ এটা এজন্য যে , আল্লাহ মু\’মিনদের হিতৈষী-বন্ধু।\’ যে রাত শেষে ভোরে তিনি ইন্তেকাল করবেন সেই রাতে তাঁর অবস্থা তো বড়ই ঈর্ষনীয়। তিনি আল্লাহর জিকিরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কতক্ষণ পর পর মহান আল্লাহকে সম্বোধন করে \”ও মুনীব ও মুনীব\” বলে আওয়াজ করতে থাকেন। নিজের সন্তানদের উদ্দেশ্য করে বলেন, আমি তোমাদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। তোমাদেরকে আল্লাহর হাতে শপে দিলাম। অতপর ১জুন সোমবার ২০২০ইংরেজি সনের রাত ৪টা ৫০মিনিটের সময় তাঁর মুনিবের ডাকে চলে যান। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া-ইন্নাইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।
লিখেছেন- হাতিম আল ফেরদৌসী