সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দেদী রাহ.

March 23 2019, 09:02

নাম :- শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দেদী রাহ.

জন্ম / জন্মস্থান :- ভারত

শৈশব কাল :- চলে এসেছে ১৮১৯ সাল। হাজির হয়েছে ১২৩৫ হিজরি সন। ভাগ্যের তারকাগুলো মুচকি হাসছে। আকাশে আনন্দ করছে। নতুন এক অমীয় প্রবাহের অপেক্ষায় সারাটা পৃথিবী। সবাই প্রহর গুনছেন, মহাত্মা এক আত্মার। অবশেষে আহলে দিল, আহলে ফন, ‘শাহ আবু সাইদ’ শাহ আব্দুল আজীজ রাহ. এর বিশেষ ছাত্র। সময়ের বিশ্বস্ত মুহাদ্দিস এর ঔরসে জন্ম হয় আগামির শাহ, মুহাদ্দিস, মুজাদ্দিদ ও মুহাজিরে মাদানি আব্দুল গণী এর। আলহামদুলিল্লাহ!
পিতা, ‘শাহ আবু সাইদ’ রাহ.। অত্যন্ত পবিত্র স্বভাব ও মহান চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ছিলেন রাতের আবিদ ও দিনের মুখলিস মুজাহিদ। ভাল ফারসি জানতেন। চাল-চলন ছিল একেবারে সহজ-সরল, সাদা-সিধে।
আশপাশে তখন চলছিল বুদ্ধিপূঁজার মহোৎসব। যুক্তির ছিল লাগামহীন স্বাধীনতা। পরিবেশ ছিল কথার যাদুতে মোহগ্রস্ত। ইংরেজ, শিআ ও খৃস্টান এবং শিখ সম্প্রদায়ের উৎপাত। এমন পরিবেশে মাওলানা ‘শাহ আব্দুল গণী রাহ. বড় হতে থাকেন। দৃশ্যত সাধারণ নিয়মের তুলনায় তিনি ছিলেন অনন্য। ভেতরে তাঁর তীক্ষ্ম মেধা। বাহিরে বুদ্ধির দীপ্তি। চলনে-বলনে উন্নত চিত্র ও মহান চরিত্র। বুকে সীমাহীন সাহস। বাহুতে আলৌকিক শক্তি। শক্ত মনোবল। উচ্চারণে সব সময় থাকতো পাকা-পাকা বুদ্ধির কথা ও তাক লাগানো উপস্থাপনা।

শিক্ষা জীবন :- প্রাথমিক লেখাপড়ার হাতেখড়ি মা-বাবার কাছে। হাদীস-শাস্ত্রের কিছু কিতাব পড়েন বাবার কাছে এবং আরো কিছু কিতাব পড়েন শাহ ইসহাক রাহ. এর কাছে। সময়ের ব্যবধানে ভারতর্ষের জ্ঞানজগতে হয়ে ওঠেন বটবৃক্ষ। দীপ্তিমান আলোকবর্তিকা। প্রজ্ঞাবিজ্ঞানের সম্রাট। হিমালয় পর্বতসম ইতিহাস কাঁপানো ব্যক্তি। ভারত উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ। ভারত বর্ষের ইতিহাসে তাঁর কুরআন-হাদীসের দারস ও দারসগাহই ছিল তখনকার সময়ের ইলমের একমাত্র রাজসিংহাসন। কুরআন-হাদীসের আলো দিয়ে ভারতবর্ষের আসমান যেসকল ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব আলোকিত করেছেন, জমীন যেসকল সংগ্রামি মুজাহিদ পবিত্র ও উর্বর করেছেন- তাঁদের সবাইই তাঁর হাড়ভাঙ্গা মেহনতের সফল ফসল। আবু হানীফায়ে ছানী রশীদ আহমদ গাঙগুহী ও হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতুবী ও ইয়াকুব নানুতুবী রাহ. তাঁর অন্যতম শিষ্য। যাঁদের একেকজন ছিলেন পুনর্জাগরণের প্রাণপুরুষ। সিপাহী বিপ্লবের নেতা। থানাভবনে ঘোষিত ইসলামি হুকুমতের একজন ছিলেন প্রধান বিচারপতি আর আর আরেকজন ছিলেন প্রধান সেনাপতি। সময়ের সামান্য ব্যবধানে জ্ঞানজগতে তাঁরা তৈরি করেছেন দীপ্তিমান অনেক চন্দ্র-সূর্য ও আলোকিত অনেক তারকা। পৃথিবীতে সৃষ্টি করেন সময়ের সোনালি মানুষের সুন্দর পরিবেশ। পরিবর্তন করেন দূষিত আবহাওয়া।

কর্ম জীবন :- পুনর্জাগরণের সংগ্রামী নায়ক
শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দিদি রাহ.

ইতিহাস অনেকে ভয় পান। অনেকে খারাপ পান। ইতিহাস ভালও লাগে এরকম এক নয়, অনেক আছেন। কারণ ইতিহাসভীরুরা ভাবেন ইতিহাস মানেই বিরাট ও কয়েক খ-। আসলে ইতিহাস মানে বিরাট কিতাব নয়, বিশাল কলেবর নয়। অনেক সময় এক-দু’ পৃষ্ঠায়ও তা হজম করা যায়। আবার কয়েক খ- পড়েও তাজাবরকাটা যায়। কিন্তু বিশাল খ-ের ইতিহাস পড়তে গিয়ে অনেক সময় ইতিহাসের তৃষ্ণা বিতৃষ্ণায় পরিণত হয়। ইতিহাসের তৃষ্ণা বাড়াতে জানতে যাবো কয়েক পৃষ্ঠায় লম্বা ইতিহাস। চলুন- হাঁটা শুরু করি।
সুলতানী আমলের শাসন ভারতবর্ষে চলমান ছিল ১২০৬-১৫২৬ খৃ. পর্যন্ত। শেষ টার্ম ১৪৫১-১৫২৬খৃ. অতিবাহিত হয় লোদী বংশের শেষ শাসক ইব্রাহীম লোদি (১৫১৭-১৫২৬) এর হাতে। কাবুলের আমীর মোঘল বংশোদ্ভূদ স¤্রাট বাবর ইব্রাহীম লোদির ভারতে হামলা করে ১৫২৬ সালে দিল্লি দখল করেন। এতে ৩২০ বছরের সুলতানী শাসন ও সত্তুর বছরের লোদী শাসনের অবসান হয়। প্রতিষ্ঠা হয় মোঘল সা¤্রাজ্য। একসময় মোঘলদের দলাদলি, স্বজনপ্রীতি, অনিয়মতান্ত্রিকতা, দুর্নীতি, অধর্ম, অবিচার, অন্যায়, স¤্রাটদের আমোদ-প্রমোদ ও বিলাসিতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সিপাহী বিপ্লবের নির্মম ব্যর্থতার পরিস্থিতিতে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত ১৯জন মোঘল স¤্রাটের ৩৩২ বছর রাজত্ব চলে।
১২০৬ সালে সুলতানী আমল শুরুর প্রেক্ষপট ছিল ঈমানদীপ্ত। দুই দশক ঈমানদীপ্ত চেতনায় চলতে থাকে। উল্লেখযোগ্য সময় যেতে না যেতেই দুঃখজনকভাবে শুরু হয়ে যায় অধর্ম আর অনাচারের অসৎ চর্চা। চলতে থাকে বিরামহীন। বাড়তে থাকে অন্যায়। বিচ্ছিন্নভাবে মাঝে-মধ্যে থেমেও থাকে। চতুর্দিক আঁধার এবং আন্ধকার। আঁধার ঘেরা জগত হিজরি ১ম হাজারে যতটা প্রকট ছিল হিজরি ২য় হাজারে গিয়ে তা আরো তীব্রতর হয়। হিজরি প্রথম হাজারের অন্ধকার দূর করতে ঈমানদীপ্ত কর্মপন্থা নিয়ে আবির্ভূত হন উমাইয়্যা সা¤্রাজ্যের ৮ম খলীফা মুজাদ্দিদ উমর ইবনে আব্দুল আজীজ রাহ. (৬১-১০১ হি.)। হিজরি ২য় হাজারের ভয়াবহ জাহিলিয়্যাত দূর করতে বুদ্ধি, বিজ্ঞান আর চেতনাদীপ্ত কর্মপন্থা নিয়ে স¤্রাট আকবরের যুগে আবির্ভূত হন মুজাদ্দিদ শায়খ আহমদ সারহিন্দি মুজাদ্দিদে আলফে সানি (৯৭১-১০৩৪ হি.) রাহ.। সময়ের ব্যবধানে মুসলমানদের চেতনায় নেমে আসে জাতীয় অরাজকতা, স্থবিরতা, নৈরাশ্য, লক্ষ্যহীনতা আর জাহালতপ্রীতি। সাময়িক ঢাকা পড়ে যায় মুজাদ্দিদে আলফে সানীর কর্মসূচির বাস্তবচিন্তা। থেমে যায় জাগরণী চিন্তাচর্চার পরিচর্যার গতি। দেখা দেয় সময়ের সংগ্রামী সাধকের নতুন প্রয়োজন। মুজাদ্দিদে আলফে সানীর কর্মসূচিকে সামনে রেখে নতুন আঙিকে মুসলিম জাতীয় পুনর্জাগরণের পটভূমি তৈরি করেন শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. (১১১৪-১১৭৬ হি./১৭০৩-১৭৬২ ঈ.)।
তিনি সকল উল্টো ¯্রােতের কুরআনিক ও যৌক্তিক পাল্টা জবাব দিয়ে এগিয়ে যান লক্ষ্যপানে। ৩০ বছর বয়সে আধ্যাত্মিক শক্তি আরো ধারালো করতে সফর করেন হেজাজভূমি। চলে যান বায়তুল্লাহের জিয়ারতে এবং আহলুল্লাহ ও আহলে ইলমদের মুলাকাতে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে পূর্ণ আরো পরিপূর্ণ হয়ে ভারতে ফিরেন। রচনা করেন ‘ফুয়ুজুল হারামাইন’-নামক সফরনামা বা স্মৃতিগ্রন্থ। সেখানে লেখেন- তিনি নিজেকে এক বিক্ষুব্ধ জনতার মাঝে দেখেন। এতে রয়েছেন আরবি-আজমি মুসলিম। মুসলিম মিল্লাতের চিন্তা, চেতনা ও সংস্কৃতিতে বিজাতীয় আগ্রাসনের কারণে সবাই ক্ষুব্ধ এবং বিক্ষুব্ধ। সবাই তাঁর কাছে এসে তাকে জিজ্ঞেস করছেন- এখন করণীয় কী? আল্লাহর নির্দেশ কী? তাঁর মুখ দিয়ে তখন বের হচ্ছে ‘ফুক্কা কুল্লা নেজাম’! সকল (বাতিল) ব্যবস্থা তছনছ করে দাও। অর্থাৎ ঘুণেধরা সমাজ ভাঙতে হবে, ইসলামি সমাজ গড়তে হবে। ১১৪৬ এ দেশে ফেরেন। মানব-রচিত মতবাদের বিভ্রান্তিজাল ছিন্ন করতে তৈরি করেন চিন্তা-গবেষণা, সত্য, সুন্দর ও ইসলামি মানস পুনর্গঠনের নতুন রাজপথ। তাঁর সকল সময় ব্যয় হয়েছে চিন্তার পুনর্গঠনে। হজ্জ পরবর্তী ৩০ বছরের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে কালজয়ী প্রায় ৫০টি মৌলিক গ্রন্থ রচনার কাজে। সফল বিপ্লবের রুপরেখা প্রস্তুতি ও সার্থক উপাদান মাঠে নিয়ে আসার জন্যে। তিনি কখনো অবসর হতে পারেন নি। মাঠে এগুলো কার্যকর করতে সক্রিয় হওয়ার জন্য চিন্তাবিন্যাস থেকে ফারেগ হতে পারেন নি। কিন্তু অনুশীলনের মধ্যদিয়ে তৈরি করেছেন রাতের একদল আবিদ এবং দ্বীনের আরেকদল মুজাহিদ। যাঁদের ধমনিতে মিশেছে ওলিউল্লাহি চিন্তা ও মাংশে প্রবেশ করেছে সংস্কারের চেতনা। বাহুতে এসেছে রাব্বানি শক্তি। হৃদয় পুষ্ট হয়েছে আধ্যাত্মিকতায়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিপুষ্ট হয়েছে পরমী শিক্ষায়, পরমের নীতি-নৈতিকতার দীক্ষায় এবং জিহাদী জযবায়। রাতের আবিদ আর দিনের মুজাহিদ এই মহান কাফেলার অন্যতম একজন-‘সিরাজুল হিন্দ’- শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ. (১১৫৯-১২৩৯ হি.)।
শাহ ওলিউল্লাহ রাহ. দু’টি বিবাহ করেন। দ্বিতীয় বিবির গর্ভে জন্ম নেন ইতিহাসের চার কিংবদন্তি। শাহ আব্দুল আজীজ, শাহ রফী উদ্দীন ও শাহ আব্দুল কাদির ও শাহ আব্দুল গণী রাহ.। শাহ আব্দুল গণী রাহ. ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। কিন্তু মাওলার সাক্ষাতে তিনি চলে যান সবার প্রথমে। ১২২৭ হিজরি সনে। অবশিষ্ট তিনজন বাবার জে¦লে যাওয়া মশাল কেবল প্রজ্জ্বোলিত রাখেন নি বরং এর দ্বারা শত-সহ¯্র প্রদীপ জে¦লেছেন এবং দীপ্তিমান রেখেছেন এক উম্মাহকে। এ ক্ষেত্রে কার্যত বাবার সার্থক প্রতিনিধি ছিলেন শাহ আব্দুল আজীজ রাহ.। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা, রুচি-অভিপ্রায়, দরসে কুরআন, হাদীস, এজাযত-ইহসান এবং ধর্মীয় জ্ঞান-বিদ্যা, সামাজিক বিষয়াদি-সহ দেশ ও দশের অধিকার, স্বাধিকার উদ্ধার-রক্ষা এবং জিহাদ-মুজাহাদার সফল উত্তরসূরি ছিলেন ৪ জন। তাঁর একান্ত খলীফা, শহীদ ও আমীরে বালাকোট, সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলবি রাহ. (১২০১-১২৪৬ হি.)। ভ্রাতুষ্পুত্র শহীদে বালাকোট- শাহ ঈসমাইল শহীদ বিন শাহ আব্দুল গণী রাহ. ও দুই দৌহিত্র শাহ মুহাম্মদ ইসহাক (১১৯৭-১২৬২ হি.) ও শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব রাহ. (১২০০-১২৮২ হি.)।
শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ. প্রায় ৬৪বছর দারসে হাদীসের খেদমত করেন। তৈরি করেন হাদীস-জগতের অবিসংবাদিত মুহাদ্দিস এবং শারিহ। যাঁদের একজনেরও নজীর দেখাতে আজ পুরো পৃথিবী অক্ষম। তাঁদের সংখ্যা প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। আবার একেকজনের হাতধরে গড়ে উঠেছেন হাজারো মুহাদ্দিস এবং শত-শত শায়খুল হাদীস। আপন দৌহিত্র কারি, শাহ মুহাম্মদ ইসহাক রাহ.-স্বমহিমায় ভাস্বর, আপন ঐতিহ্যে প্রোজ্জ্বল এক নাম। প্রিয় পাঠক! চলে এসেছি আলোচ্য বিষয়ে। পা রাখতে যাচ্ছি মূল শিরোনামে। লক্ষ্য করুন!- এই কারি, শাহ মুহাম্মদ ইসহাক রাহ. এর হাতেগড়া কাবিল, মকবুল, আবিদ, তালিব ও মুজাহিদ এবং প্রচারবিমুখ এক মহান মুজাহিদের নাম হচ্ছে- ‘শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দিদি, মুহাজিরে মাদানি রাহ.’।

আমীরুল মুজাহিদ, সায়্যিদ আহমদ বেরলবি রাহ. এর নেতৃত্বে শিখদের বিরুদ্ধে বালাকোট প্রান্তরে প্রাণান্তকর জিহাদ চলছে। তিনি শহীদ হন। শহীদ হন মুজাহিদ হযরত শাহ ঈসমাইল বিন শাহ আব্দুল গণী রাহ.সহ আরো অনেক। ফলে কুফর, শিখ ও ইংরেজবিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা হ-য-ব-র-ল হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। তখন আন্দোলনের নেতৃত্ব তিনটি কেন্দ্রে সম্প্রসারিত হয়। দিল্লি ছিল প্রধান কেন্দ্র। এর নেতৃত্বে ছিলেন শাহ ইসহাক রাহ.। কিছুদিন পরে তিনি মক্কায় চলে যান। কিন্তু এই দিল্লি থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে যান- শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দিদী রাহ. এর কাঁধে। যুদ্ধনেতৃত্ব, পরিচালনা যোগ্যতার গভীরতা প্রমাণের জন্য উস্তাদকর্তৃক ছাত্রকে দায়িত্ব দেয়াটাই যথেষ্ট।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া হয় মূলত দু’টি কেন্দ্র থেকে। একটি ছিল থানা ভবনে। এর নেতৃত্বে ছিলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী ও ‘শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দিদি রাহ.’ এর একান্ত শাগরদি রশীদ আহমদ গাঙগুহী ও কাসিম নানুতুবী রাহ.। ১৮৭৫ সালের বিপ্লবের পর হযরতের দরসগাহের কার্যক্রম ইংরেজ সরকার মেনে নিতে পারে নি। তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হয় চেতনার উৎস এই দারসগাহটি। নানান ষড়যন্ত্র, হুমকি-ধমকি দিয়ে এর কার্যক্রম বেনিয়ারা একেবারেই বন্ধ করে দেয়। কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন হযরত মুজাদ্দিদি রাহ.। কে সামলায় এই কুরআনপ্রেমিককে? কে বাঁধা দেয় এই প্রভুপ্রেমিককে? হিজরত করে চলে যান মদীনা মুনাওয়ারায়। সেখানে চলতে থাকে কুরআনের তাফসীর আর হাদীসের দারস। বাড়তে থাকে প্রভুপ্রেম আর রাসুলভক্তি। সেই প্রেমের মদীনা শরীফে ১২৯৬ হিজরি সনের ৬মহররম ১৮৭৮ সালে পরমের পরম আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে যান প্রভুর সান্যিধ্যে। ইন্নলিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজিউন। পরম শান্তিতে তিনি এখন শোয়ে আছেন মদীনার মাকবারাতে।
আব্দুল হাই লকহনবি রাহ. নুজহাতুল খাওয়াতির কিতাবে মুজাদ্দিদি রাহ. সম্পর্কে লেখেন- ইলম (জ্ঞান), আমল, যুহদ (আধ্যাত্মিকতা), ধৈর্য্য, সাদাকত (সততা), আমানত (বিশ^স্ততা), ইফ্ফত (চারিত্রিক নির্মলতা), সিয়ানত (রক্ষণাবেক্ষণ), সুন্দর নিয়ত, আন্তরিকতা, আল্লাহমুখিতা, খোদাভীতি, সুন্নাহ অনুসরণ, উত্তম চরিত্র, প্রভুপ্রেমে ধ্যানমগ্নতা, সমাজসেবা এবং দুনিয়া বিমুখতার মহান গুণের অধিকারী হিসেবে তিনি ছিলেন সময়ের প্রথম ও প্রধান প্রবাদপুরুষ এবং সর্বশেষ ব্যক্তি। তাঁর ইলমি মাজালিস ও তাকারিরের আলোঘেরা আকাশে হাজারও উলামা হযরাত ওড়াওড়ি করেছেন। নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর সততা, সত্যতা, মহত্বতা, স্বচ্ছতা ও পবিত্রতা এবং চারিত্রিক নির্মলতার বিষয়ে আরব-আজমের সাধারণ অসাধারণ সবাই একমত।
শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. ‘র্আওয়াহে ছালাছাহ’ কিতাবের ১৯১ পৃষ্ঠায় গাঙগুহি রাহ. এর সনদে লেখেন, হযরত ইসহাক রাহ. এর শাগরিদদের মধ্যে তিনজন খুব মুত্তাকি ছিলেন। প্রথম ছিলেন- মুযাফ্ফর হোসাইন, দ্বিতীয় ছিলেন- শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দিদী ও তৃতীয় ছিলেন- নবাব কুতুবুদ্দীন সাহেব রাহ.।
মুজাদ্দিদি রাহ. এর বিশেষ শাগরিদ উস্তাদুল কুল মাওলানা মামলুক আলি রাহ. এর ধারাবাহিকতায় শুরু হয় পরবর্তী প্রজন্মের পথচলা। মাওলানা মামলুক আলি নানুতুবি রাহ. তাঁর সাথে কাসিম নানুতুবি রাহ.কে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। এবার কাসিম নানুতুবি রাহ. এর লেখাপড়ার দায়িত্ব মামলুক আলি নানুতুবি রাহ. এর হাতে। তিনি তাঁকে নাহুশাস্ত্রের ‘কাফিয়া’ কিতাব, মানতিক ও দর্শনশাস্ত্রের প্রয়োজনীয় কিতাব সর্বোচ্চ যতœসহকারে পড়িয়ে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও দক্ষতার প্রতিটি শাখায় তাঁকে সমৃদ্ধ করে তুলেন। অবশেষে আপন যোগ্যতা ও প্রতিভার কৃতিত্বে তিনি রাহ. দিল্লির এরাবিক কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। মামলুক আলি নানুতুবি রাহ. কাসিম নানুতুবি রাহ. কে ভর্তি করে দেন। মাওলানা ‘মাহতাব আলি’ (মৃ. ১৮৮৬ ঈ.) দেওবন্দি রাহ. কাসিম নানুতুবি রাহ. কে ‘ইলমের বকরি‘ বলতেন। নিজেকে মিটানো ও বিলানো ছিল তাঁর স্বভাবজাত গুণ। একবার নানুতুবি রাহ. বললেন, মাওলানা ‘মাহতাব আলি’ দেওবন্দি রাহ.-কর্তৃক আমাকে ‘ইলমের বকরি‘ বলা আমাকে লজ্জিত করেছে। আমার ক্ষেত্রে তিনি যদি তা না বলতেন, তবে আমি আমাকে এমনভাবে মিটিয়ে দিতাম, লোকেরা জানতই না- কাসিম নামি কেহ পৃথিবীতে আছে, কি না? এই ছিল মুজাদ্দিদি রাহ. এর পরম আদরের ছাত্র কাসিম নানুতুবি রাহ. এর ভেতর-বাইরের অবস্থার কথা। এবার অনুভব করুন কেমন ছিলো- উস্তাদ শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দিদি রাহ. এর ভেতর ও কেমন ছিলো তাঁর বাহির। আল্লাহু আকবার। উলাইকা আবাই ফাজি’ নী বিমিছলিহিম!! সেই কাসিম নানুতুবি রাহ. এর তৎপরতায় ভারতবর্ষে শুরু হয় মুজাদ্দিদে আলফে সানি, ওলীউল্লাহ দেহলবি, আব্দুল আজীজ দেহলবি, আহমদ শহীদ, ইসমাইল শহীদ, শাহ ইসহাক, মুহাজিরে মক্কি-মাদানি রাহিমাহুমুল্লাহদের চিন্তা ও চেতনার চর্চা। কুরআন-হাদীসের দর্শনের বীজ পরবর্তী প্রজন্মের রক্তে-মাংসে প্রবেশ করে দেওয়ার মুজাহাদা। প্রিয়! সাথে থাকুন, রয়েগেছে ইতিহাসের সোনালী আরো অনেক অধ্যায়। যেগুলোর চেতনাপুরুষ ‘শাহ আব্দুল গণী মুজাদ্দিদি’ রাহমিাহুল্লাহ!

উৎসগ্রন্থ
১. তারীখে দারুল উলুম
২. শানদার মাজী
৩. সংগ্রামী সাধকদের ইতিহাস
৪. আল ইআনিউল জানী
৫. নুজহাতুল খাওয়াতির
৬. আরওয়াহে ছালাছাহ
৭. আপবীতী
৮. তা বান্দাহ নুকুশ
৯. দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অবদান
১০. তালিবে ইলমের সফলতার রাজপথ

মৃত্যু তারিখ :-

সেই প্রেমের মদীনা শরীফে ১২৯৬ হিজরি সনের ৬মহররম ১৮৭৮ সালে পরমের পরম আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে যান প্রভুর সান্যিধ্যে। ইন্নলিল্লাহি ও ইন্না ইলাইহি রাজিউন। পরম শান্তিতে তিনি এখন শোয়ে আছেন মদীনার মাকবারাতে।

লিখেছেন-  লুকমান হাকিম,  জামেয়া ইসলামিয়া ফরিদাবাদ সিলেট

 

Spread the love