শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী
November 12 2018, 04:29
- জন্ম ও বংশ পরিচয়ঃ হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ) ১৭০৩ ইং বৃহস্পতিবার সূর্যোদয়ের সময় উত্তর ভারতে অবস্থিত তাঁর নাবাড়ি মুজাফ্ফর নগর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মূল নাম আহমদ, উপাধি আবুল ফয়েজ, ঐতিহাসিক নাম আযীমুদ্দীন। তবে তিনি ওয়ালীউল্লাহ নামেই জগৎখ্যাত। তার পিতা শাইখ আব্দুর রহিম। বংশগত দিক থেকে হযরত উসমান (রাঃ) এর বংশধর, মতান্তরে হযরত উমর
(রাঃ) এর বংশধর। তার মাতা ইমাম মুছা আল কাযিমের বংশধর। শিক্ষাকালঃ শৈশবেই তার আচার আচরণ ও সময়ানুবর্তিতার মধ্যে ভবিষ্যত
মাহাত্ম্যের আভাস পাওয়া যায়। জযবে লতীফ নামক গ্রন্থে শাহ সাহেব নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, যখন আমার পাঁচ বছর বয়স, তখন মক্তবে ভর্তি হই এবং পিতার নিকট ফার্সী শিক্ষা গ্রহণ করি। সাত বছর বয়সে আমার পিতা আমাকে নামায পড়ার আদেশ দেন এবং ঐ বছরই পবিত্র কুরানের হিফজ সমাপ্ত করি। অতঃপর পনের বছর বয়সের মধ্যেই তাফসীর, হাদীস, ফিক্বহ, উসূলে ফিক্বহ, তর্কশাস্ত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যামিতি ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করি। চৌদ্দ বছর বয়সে স্বীয় পিতার হাতে বায়আত গ্রহণ করি এবং এ বছরে আমি বিবাহ করি। বিবাহের মাত্র দু’বছর পর পিতার ইন্তেকাল হয়।কর্মজীবনঃ পিতার ইন্তেকালের পর শাহ সাহেব মাদ্রাসায়ে রহীমিয়াতে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। এ সময় দীর্ঘ বার বছর যাবৎ শাহ সাহেব তাঁর পরিবার ও সামাজিক পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বহু উত্থান-পতন দেখার পর উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম জাতিকে চলমান সমাজের অন্ধতা ও গোমরাহী থেকে বাঁচাতে হলে তিনটি বিষয় একান্ত প্রয়োজনঃ
যুক্তি দর্শনঃ শাহ সাহেব উল্লেখ করেন যে, তৎকালে মুসলমানেরা গ্রীক দর্শনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। আর এই দর্শনের মূল ভিত্তি হল তর্কশাস্ত্র। ফলে তখন মুসলিম সমাজে নানা রকম ফিৎনা-ফ্যাসাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। সুতরাং সমাজকে এ রোগ থেকে মুক্ত করতে হলে যুক্তি-দর্শন শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।
আধ্যাত্বিক দর্শন বা তত্ত্বদর্শনঃ সে যুগের মুসলমানেরা কুরআন- সুন্নাহকে উপেক্ষা করে শুধু আধ্যাত্বিক সাধনাকে সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করত।
এমন কি সূফিদের অনুমোদন ছাড়া তারা কোন কিছুই সত্য বলে বিশ্বাস করত না। তাই যুগের প্রেক্ষাপটে আধ্যাত্বিক সাধনা তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ বলে বিবেচিত হত।ইলম বির-রিওয়ায়াহঃ অর্থাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন হয়েছিল, এর মধ্যে কুরআনই প্রধান। শাহ সাহেব বলেন, উক্ত তিনটি বিষয় ছাড়াও তৎকালীন যুগের শিক্ষিত ব্যক্তিরা আত্মকেন্দ্রিকতার রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কোন জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হলে, কেউ কারো সাথে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না। ছোট বড় সবাই নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী শরীয়ত সংক্রান্ত বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তাঁকে উপযুক্ত তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে হয়েছে। বার বছর যাবৎ আলোচনা ,পর্যালোচনা ও গবেষণার পর সংস্কার দ্বারা সত্যোদ্ধারকে তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে তিনি মৌলিকভাবে দুটি বিষয়ের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেনঃ মানুষের ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টি ভঙ্গিই প্রকৃত পক্ষে কুরআনের অলৌকিকত্ব। পবিত্র কুরআনের এ ব্যবহারিক মূল্যায়নের প্রতিষ্ঠাকে তিনি তাঁর শিক্ষা সংস্কারের বুনিয়াদ রূপে গ্রহণ করেছিলেন। . সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের
অভাবকে সমাজ-রাষ্ট্র ও জাতীয় জীবনেরনৈতিক ব্যবহারিক বিপর্যয় ও বিশৃংখলার কারণ বলে তিনি নির্দেশ করেছিলেন।
শাহ সাহেব এই দুইটি বিষয়কে সামনে রেখে তাঁর আন্দোলনের পথ যাত্রা শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, যদি কুরআনের অলৌকিকত্ব একমাত্র তাঁর ভাষাগত অলংকারেই সীমাবদ্ধ হয়, সেক্ষেত্রে কেবল নির্দিষ্ট সংখ্যক লোক
ব্যতীত আর সবাই কুরআনের মাধুর্য থেকে বঞ্চিত থাকবে। তাই তিনি কুরআনের
ব্যবহারিক দিক ও অর্থনৈতিক সমতাকেও তাঁর সংস্কারমূলক কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত
করেছিলেন। সাধারনভাবে নৈতিক জীবনবোধই হচ্ছে আধ্যাত্বিকতার ভিত্তি।
আর নৈতিকতার বিকাশ তখনই ঘটবে,যখন অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ
হওয়া যাবে। কিন্তু মানবজীবনের সাথে জীবিকার এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক
কেউ কোনদিন উপলব্ধি করেনি। ফলে হয়েছে এই যে, আমাদের রাষ্ট্র
ব্যবস্থা সার শূন্য হয়ে পড়েছে। বিদ্বান ও আধ্যাত্বিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা দেশের
রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকাকেই জীবনের সাফল্য মনে করত। পক্ষান্তরে শাহ সাহেব এ বাস্তবতাকে হকের নিরিখে বিচার করেছেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থ
‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ’তে এ বিষয়ে বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
মোটকথা সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিধান একান্ত জরুরী। কারণ
জীবিকা সংস্থানের দুশ্চিন্তা থেকে অবকাশ লাভের পরেই মানুষ নীতি,আদর্শ ও অন্যান্য দিকের উন্নতির প্রতি মনোযোগ দিতে পারে। তা না হলে মানবজীবন পশুজীবনে পরিণত হওয়া স্বাভাবিক। শাহ সাহেব এ সত্য উপলব্ধি করে মুসলিম মিল্লাতকে এ ঘোর অমানিশা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এ বিষয়ে সুষ্ঠু ও তত্ত্বমূলক গবেষণার জন্য তৈরী হন। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন হাদীস শাস্ত্রে পূর্ণ পাণ্ডিত্য।
দিল্লীতে আশানুরূপ হাদীস গ্রন্থ না থাকায় তাকে হিজায সফর করতে হয়।
হিজায সফর ঃ শাহ সাহেব নিজে উল্লেখ করেন, দীর্ঘ বার যাবৎ এ সকল
বিষয়ে গবেষণা করার পর মক্কা-মদীনায় সফরের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ জন্মে। সুতারাং ১১৪৩ হিজরীতে মক্কা শরীফ চলে যাই এবং দুবছর সেখানে অবস্থান করে শায়খ আবু তাহির ও অন্য আলেমগণের নিকট চলে যাই এবং দু’বছর অধ্যয়ন করি। তিনি শায়খ আবু তাহির থেকে তাসাউফ এর
শিক্ষা লাভ করে ১১৪৫ হিজরীতে দিল্লিতে ফিরে এসে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। সংস্কার আন্দোলনের জন্য ফিক্বহ ও হাদীস শাস্ত্রে স্বাধীনভাবে ইজতেহাদের যোগ্যতা অর্জন করা আবশ্যক। মক্কা- মদীনায় অবস্থান করে শাহ আকবরের উদারনীতিতে যে নিয়ম ও রীতির প্রচলন হয়েছিল, তা পরিবর্তন
করে নতুনভাবে শাসন ব্যবস্থা তৈরী করা একান্ত প্রয়োজন। এ দাবিকে সামনে রেখে তিনি তাঁর আন্দালনের কর্মসূচী পেশ করেন। তাঁর কর্মসূচীকে মোটামুটি আটটি ধারায় বিভক্ত করা যায়। . মুসলিম জাতির আকীদার সংশোধন ও
কুরআনের প্রতি আহবানঃ প্রকৃতপক্ষে কোন দেশে সংস্কার আন্দোলন দ্বারা মানুষের আত্মসুদ্ধি করা অত্যন্ত কঠিন ব্যপার। এর জন্য প্রয়োজন আম্বিয়ায়ে কিরামের সংস্কার ধারা বজায় রেখে দ্বীনের পূর্ণ জাগরণ সৃষ্টি করা। সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত তথাকথিত উদার নীতির ফলে মুসলমানদের ঈমান আকীদার ক্ষেত্রে যে বিশৃংখলা বিরাজ করছিল, তা সকলেরই জানা। সহজ-সরল মুসলিম জাতির বিভিন্ন ভাবধারা ও দর্শনপন্থীদের সাথে মেলামেশার ফলে,
বিশেষ করে সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দু সংস্কৃতির একক প্রাধান্যের
কারণে ভারতবর্ষে শুধু নামধারী মুসলমানদের অস্তিত্ব ছিল। ইসলামী ধ্যান-ধারণা, ইসলামী আকীদা- বিশ্বাসের সাথে তাদের ব্যবধান ছিল
আকাশ-পাতাল। শাহ সাহেব এ সত্যকে উপলব্ধি করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এ বিপর্যয় থেকে মুসলিম জাতিকে হেফাজত করতে হলে ব্যাপকভাবে কুরআনের দাওয়াত প্রচার করতে হবে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সার্বজনীন ও আর্ন্তজাতিক।
যে যুগে যে কোন স্থানে এর বৈপ্লবিক নীতিকে অনুসরন করলে, ইসলামের
প্রাথমিক যুগে (খোলাফায়ে রাশেদীনের) ন্যায় নব জাগরনের সূচনা সম্ভব। এ কাজের আঞ্জাম দিতে গিয়ে সর্বপ্রথম ফার্সী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করেন।
যার নাম ফুতুহুর রহমান। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁকে অনেক বিপদের সম্মুখিন
হতে হয়েছে। এক শ্রেণীর আলেম তো বলেই উঠলেন, কুরআনের ভাষান্তর দ্বারা এর অলৌকিকত্ব ও মাধুর্যতা ক্ষুণহয়। সুতারাং এ কাজ কুফুরীর সমতুল্য। এক পর্যায়ে শাহ সাহেবের বিরুদ্ধে কুফুরী ফতোয়া দেওয়া হয়। কিন্তু এ কথা চির সত্য যে “কুকুরের ঘেউ ঘেউ চন্দ্রের আলোকে নেভাতে পারে না”।
তাই তাঁর অবদান পৃথিবীতে স্বীকৃতরূপে বিরাজমান রইল। . ক. জনসাধারণের মাঝে হাদীস ও সুন্নাহ ব্যপকভাবে প্রচার ও প্রসার ঘটানোঃ এ
বিষয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমে জানতে হবে
, দ্বীনের মধ্যে হাদীসের গুরুত্ব কতটুকু?
হাদীসের প্রচার ও তার সংরক্ষণ প্রয়োজন
কেন? হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ
থাকা বা অবহেলা প্রদর্শনে কী ক্ষতি?
প্রকৃতপক্ষে হাদীস হল উম্মতের ঈমান-
আকীদার জন্য মানদণ্ড
তথা মাপকাঠি স্বরূপ। শাহ সাহেবের প্রথম
কর্মসূচী ছিল কুরআনের প্রতি আহবান। এ
কাজের জন্য হাদীসের প্রয়োজন কতটুকু আর
আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। তার কারণ,
পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাই হল
সুন্নতে নববী। এরশাদ হচ্ছে “রাসুলুল্লাহ
সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম
আদর্শ।
ভারতে যে শিরক বিদআতের সয়লাব
দেখা দিয়েছিল, তার একটা কারণ এও ছিল
যে, হাদীস ও সুন্নাতে নববীর
প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হত।
“রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যখন
কোন সম্প্রদায় একটি বিদআতে লিপ্ত হয়,
তখন তাদের থেকে একটি সুন্নাত
উঠিয়ে নেওয়া হয়” (মিশকাত)। শাহ সাহেব
সমাজ থেকে শিরক-বিদআতের প্রচলন রহিত
করার জন্য সুন্নাতে নববী এবং হাদীস
শাস্ত্রের ব্যাপক প্রচার-প্রসার শুরু করেন।
মূলতঃ তিনিই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম
হাদীসের দরস চালু করেন। হাদীসের
ক্ষেত্রে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে।
তন্মধ্যে লিখিত মুছাফ্ফা, মুছাওয়া,
শরহে তরজমায়ে সহীহে বুখারী, আল-ফসলুল
মুবীন মিন হাদীসিন নাবিয়্যিল আমিন
ইত্যাদি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
খ. ফিক্বহ ও হাদীসের মাঝে সমন্বয়ঃ যুগ
যুগ ধরে মুসলমানেরা হাদীস ও ফিকাহের
চর্চা করে আসছে, কিন্তু তা ছিল বিভিন্ন
ভাবে। শাহ সাহেব সর্বপ্রথম হাদীস ও
ফিক্বহের মাঝে সমন্বয় সাধন করেন।
. যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যার আলোকে কুরআনিক
দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন এবং সুন্নাতে নববীর
রহস্য উদঘাটনঃ
অনেকে ধারণা করে থাকেন যে, শরীয়তের
হুকুম-আহকাম কোন উদ্দেশ্যের উপর
প্রতিষ্ঠিত নয়। কাজের সাথে তার
ফলাফলের কোন সম্পর্ক নেই। এ ধারণা ভুল।
ইজমা, কিয়াস ও খাইরুল কুরুন উক্ত
মতবাদকে খণ্ডন করেছে। যেমন নামায। এ
হুকুম আল্লাহকে স্মরণ করা এবং তাঁর
মুনাজাতের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গরীব
ও অসহায়দের অভাব অনটন দূর
করা এবং অন্তর থেকে কৃপণতার ছাপ
মুছে ফেলার জন্য যাকাতের বিধান দান
করা হয়েছে। অন্তরকে কুপ্রবৃত্তির প্রভাব
থেকে মুক্ত রাখার জন্য সিয়াম
বা রোযা ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহর
বাণীর ব্যপক প্রচার-প্রসার এবং ফিৎনা-
ফ্যাসাদ দূর করার লক্ষ্যে জিহাদের
ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি।
অনুরূপভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশ-নিষেধের
মধ্যেও কোন কোন রহস্য লুকায়িত রয়েছে।
যেমন যোহরের পূর্বে চার রাকাত নামায
সম্বন্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ঐ আকাশের
দ্বার উন্মুক্ত করা হয়, আমার ইচ্ছে হয় এ
সময় যেন আমার নেক আমল উর্ধ্বারোহন
হয়”। এভাবে প্রত্যেক হুকুমের মাঝে কোন
কোন রহস্য লুকায়িত রয়েছে। এক শ্রেণীর
মানুষ মনে করত, ইসলামী হুকুম-আহকাম
যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ
করা এবং এগুলোর রহস্য উদঘাটন
করা ইসলামের জন্য ক্ষতিকারক। শাহ
সাহেব বলেন এ ধারণা ভুল। কারণ যুক্তির
আলোকে ইসলামী হুকুম-আহকামকে বিচার-
বিশ্লেষণ করলে ক্ষতি নয় বরং উপকার হবে।
যেমন আমলের প্রতি আগ্রহ বাড়বে,
এছাড়া ফিক্বহী ইজতেহাদের
ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে।
এদিকে লক্ষ্য করে শাহ সাহেব এ
কাজকে তার বিপ্লবী কর্মসূচীর অর্ন্তভূক্ত
করেন।
. ইসলামী খিলাফতের ব্যাখ্যা ও তার
সততা প্রমাণ এবং বিরুদ্ধবাদীদের সমূচিত
জবাবঃ আল্লাহ পাক
মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার দাসত্ব করার
জন্য। সাথে সাথে পৃথিবীর
পরিচালনা সুষ্টুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য
যে দায়িত্ব দিয়েছেন তা হল খিলাফত। এই
খিলাফত মানব জীবনের একটি মৌলিক
বিষয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বহু
কল্যাণকর দিক। শাহ সাহেব এর গুরুত্ব ও
প্রয়োজনীয়তা জনসাধারনের
মাঝে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন তার
কোন তুলনা নেই। তিনি তাঁর ইযালাতুল
খিফা নামক গ্রন্থে খিলাফতের
ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন, “খিলাফত অর্থ-
সাধারনের ক্ষমতা লাভ করায়
ইলমে দ্বীনকে জিন্দা করার মাধ্যমে দ্বীন
প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ইসলামের বিধি-
বিধান ও জিহাদ এবং তার সংশ্লিষ্ট
বিষয়াদী যেমন সৈন্য বিন্যাস,
যোদ্ধা তৈরি ইত্যাদি সংস্থাপনের জন্য
এবং দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা, জুলুম শাষণ
বিনাশ করা, সুপথের আদেশ ও কুপথের
নিষেধ প্রভৃত্তিকে কায়েম করা হযরত
রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্থলাভিষিক্ত
রূপে”।
এসময় আরো একটি বিষয় মুসলমানদের
মাঝে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, তা হল
খিলাফতে রাশেদা সম্পর্কে সন্দেহ
প্রকাশ। শাহ সাহেব বিরুদ্ধবাদীদের এ
সকল ভ্রান্ত ধারণাকে এমন ভাবে খণ্ডন
করেন, যা যথাযথই যুক্তিযুক্ত ছিল। তাঁর
সবগুলি যুক্তিই ছিল কুরআন হাদীসের
ভিত্তিতে প্রণীত। তিনি এ
ব্যাপারে একটি গ্রন্থ ও রচনা করেছেন, তার
নাম ইযালাতুল খিফা আন খিলাফাতিল
খুলাফা।
. শ্রমজীবিদের উপর থেকে অত্যধিক চাপ
রহিত করা এবং শ্রমিক শ্রেণির যথাযথ
মূল্যায়ন দানঃ শাহ সাহেব বলেন,
শ্রমজীবীদের উপর থেকে চাপ রোধ
করা ব্যতীত সমাজে ভারসাম্য
সৃষ্টি হতে পারে না। (বাস্তব প্রমান
সেবিয়েত ইউনিয়নের পতন)। অতীতে রোম
পারস্য যে নৈতিক অধঃপতন
নেমে এসেছিল, তার মূল কারণ ছিল শ্রমিক
নিপিড়ন। সুতারাং সমাজে ভারসাম্য
ফিরিয়ে আনতে হলে কুরআনের সেই
বৈপ্লবিক চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে।
শাহ সাহেব সেই
চেতনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যাবতীয়
পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
. উম্মতে মুহাম্মদীর সর্বস্তরের জনগণের
প্রতি সংশোধনের আহ্বানঃ শাহ সাহেব
দরস-তাদরীসের পাশাপাশি সমকালীন
সামাজিক বিশৃংখলা ও তার
ব্যাধি সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ছিলেন।
তিনি সমাজের সর্বস্তরের রোগ
সম্পর্কে অবগত হয়ে সকলকে সংশোধনের
প্রতি আহবান জানান।
. শিক্ষা ও তরবিয়তের মাধ্যমে যোগ্য
উত্তরসূরী তৈরী করাঃ
যারা পরবর্তীতে তার
আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পরেন
এরূপ কিছু মুজাহিদ তৈরী করা ও তার
কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত ছিল। এরই প্রতিফলন হল
শাহ আব্দুল আজিজ, শাহ মুহাম্মদ ইসহাক,
মুহাম্মদ বেলায়ত আলী, সৈয়দ আহমদ
বেরেলভী, শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল
হাসান দেওবন্দী, শাইখুল ইসলাম
মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ)
(যার আলোচনা পরে করব ইনশা আল্লাহ)
প্রমুখ আলেমগণ।
. সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও
দূর্যোগের কবল থেকে মুসলিম
জাতিকে উদ্ধার করাঃ পূর্বেই উল্লেখ
করা হয়েছে যে, সম্রাট আলমগীরের মৃত্যুর
পর ভারতে যে রাজনৈতিক
বিশৃংখলা দেখা দিয়েছিল,
তা মুসলমানদের জন্য খুবই বিপদজনক ছিল।
শাহ সাহেব মুসলিম জাতিকে এ দূর্যোগ
থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে জনসাধারনের
মাঝে জিহদী প্রেরণা সৃষ্টি করেন।
ইন্তেকালঃ ৫৯ বছর বয়সে ১১৭৬ হিজরীর ২৯শে মুহাররম জোহরের সময় হযরত শাহ
ওয়ালি উল্লাহ (রহঃ) দিল্লিতে ইন্তেকাল
করেন। মৃত্যুকালে তিনি চারজন যোগ্য
সন্তান রেখে যান। তারা হলেন শাহ আব্দুল
আজিজ, শাহ বদিউদ্দীন শাহ আব্দুল কাদির
ও শাহ আব্দুল গণী।
রচনাবলীঃ বিশেষজ্ঞদের মতে তার
রচনাবলী দুইশতের অধিক। হাদীছ, তাফসীর,
ফিক্বহ, উসূলে ফিক্বহ,
রাষ্ট্রনীতি তাসাউফ নির্বিশেষে প্রায়
সকল ক্ষেত্রেই তার অবদান রয়েছে।