১. সর্বক্ষেত্রে সালফে সালেহীন তথা আমাদের অনুকরণীর পূর্ব পুরুষদের শিক্ষা দীক্ষা ও নীতির পূর্ণ অনুসরণ ও ইসলামের সেবায় তাদের অনুসৃত পদ্ধতির পূর্ণ অনুকরণ করা।
২. মুসলিম জনসাধারণের সাথে সুসম্পর্কের বন্ধন সুদৃঢ় ও সম্প্রসারিত করা। ইসলামবিরোধী শক্তির বিষাক্ত আক্রমণ থেকে সাধারণ মুসলমানের ঈমান আকিদাকে সুরক্ষিত রাখা। মুসলিম হিসেবে প্রত্যেককে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।সেইসঙ্গে এই ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা দেয়া যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দান করার অর্থ ছাত্রদের উপর অনুগ্রহ বা দয়া করা না বরং এখানে দান করে ইসলামী শিক্ষা দীক্ষা ও সভ্যতা সংস্কৃতির ভিত মজবুত করণে ভূমিকা রাখা মুসলমান হিসেবে তার উপর অর্পিত দায়িত্বসমূহের একটি বিশেষ অংশমাত্র।
৩. আধুনিক সভ্যতার নামে পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী যেসব সংস্কৃতি আমাদের দেশে আমদানী করা হয়েছে বা হচ্ছে তার ভয়াল থাবা থেকে মুসলমান জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা। যাতে জনগণ সেইসব ষড়যন্ত্র থেকে মুক্ত থাকতে পারে।
৪. আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুব সমাজের মন-মস্তিষ্ককে পাশ্চাত্য শিক্ষার কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করে তাদের ভেতর আত্মমর্যাদাবোধ ও দেশপ্রেম সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালানো।
৫. হানাফী মাযহাবের পুরোপুরি অনুসরণপূর্বক কুরআন হাদিস দ্বারা স্বীকৃত অন্যসব মাযহাবের প্রতি সুধারণা পোষণ করা। সত্যের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত প্রত্যেক মাযহাবকেই সঠিক মনে করা এবং সেসবের প্রতি তুচ্ছ ধারণা না রাখা। কুরআন হাদিসের অনুসরণের নামে ভন্ড ফকিরদের পুজা করে ইসলামকে হাসি তামাশার পাত্র বানানোর ষড়যন্ত্র থেকে মুসলিম সমাজকে বিরত রাখা।
৬. দ্বীনী ইলমের হাকিকত, তাসাউফ তথা আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জন এবং তাযকিয়ায় নফস তথা আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে ইসলামী শরিয়তের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছা।
৭. বিদআত ও কুসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়তের বাস্তব প্রতিফলন ঘটানো।
৮. মুসলিম রাষ্ট্র বা সরকারের আনুগত্য এবং পূর্ণ সমর্থন করা। এর বিরুদ্ধাচারণকে সম্পূর্ণ বেআইনি মনে করা। যদি রাষ্ট্রের কর্ণধারেরা অজ্ঞতাবশত ইসলাম বা শরিয়তবিরোধী কার্যকলাপে মুসলিম জনতাকে বাধ্য করার অপচেষ্টা চালায় তবে তার প্রতিরোধে সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৯. আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষত বিজ্ঞানের সকল প্রযুক্তিকে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়ক ও উপকারী মনে করা। বিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তিকে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক মনে না করা। ঠিক একইভাবে প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে তাসাউফের পরিপন্থী মনে না করা। আধুনিক শিক্ষা বা বিজ্ঞান প্রযুক্তির নামে যদি বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা এবং খোদায়ী বিধানের বিরোধীতাকে উস্কে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয় তাহলে তা প্রতিরোধের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১০. রাজতন্ত্র ও পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ ইসলাম পরিপন্থী মনে করা। ইসলামী গণতন্ত্র এবং সৎ ন্যায় পরায়ণ ও ইসলামী আদর্শে আদর্শবান ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী শুরায়ী নীতিকে সমর্থন ও অনুমোদন দেয়া।
১১. জ্ঞানার্জনের একটি মাত্র উদ্দেশ্য থাকবে। আর তা হল, এই জ্ঞানের আলোকে নিজের জীবনকে গড়ে তোলা।
দারুল ইকামার কানুনসমূহ :
দারুল ইকামায় অবস্থানরত প্রত্যেক ছাত্র নিম্নোক্ত কানুন ও নিয়মাবলি পুরোপুরি মেনে চলতে বাধ্য থাকবে।অমান্যকারী শাস্তি বা বহিস্কারযোগ্য হবে।
১. দশ বছরের ছোট কোন ছাত্র নিজ জিম্মাদার ব্যাতিত দারুল ইকামায় অবস্থান করতে পারবেনা।
২. ক্লাস টাইম ছাড়া দারুল ইকামায় অবস্থানরত ছাত্ররা মাগরিবের পর থেকে রাত দশটা অথবা সাড়ে দশটাপর্যন্ত এমনভাবে তাকরার মুতালা এবং লেখাপড়ায় লিপ্ত থাকবে যাতে অন্যের পড়ালেখায় কোন ধরণের ব্যাঘ্যাতসৃষ্টি না হয়।
৩. হেফজ ও মক্তব বিভাগের ছাত্ররা নিজেদের বিভাগ কর্তৃক নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী লেখাপড়ায় লিপ্ত থাকবে।
৪. জামেয়ার প্রত্যেক ছাত্রের আচার-আচরণ, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছেদ, দাড়ি, টুপি পুরোপুরি সুন্নাত মুতাবেক হতে হবে। সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে এমন কোন আচার-আচরণ এবং কাজ-কর্মে কোন ছাত্র জড়িত হতে পারবেনা।
৫. জামেয়ার ছাত্রদের জন্য যে কোন ছাত্র সংগঠন এবং অন্য যে কোন দল সংগঠন বা সংস্থার সদস্যপদ গ্রহণ করা বা দলীয় কোন কর্মতৎপরতা চালানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। প্রমাণিত হলে তাৎক্ষনিকভাবে মাদরাসা থেকে বহিস্কার করা হবে এতে কোন ওজর আপত্তি গ্রহণযোগ্য হবেনা।
৬. নিজেরা কোন প্রকার ঝগড়া বিবাদে জড়াবে না। কোন কারনে এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে দারুল ইকামার উস্তাদদের জানিয়ে তার সমাধান করিয়ে নিতে হবে।
৭. মাদরাসার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোন ছাত্র বহিরাগত কোন ব্যক্তিকে দারুল ইকামায় ডেকে আনতে পারবেনা।
৮. দারুল ইকামায় অবস্থানরত কোন ছাত্র দায়িত্বশীল উস্তাদদের অনুমতি ছাড়া রাতে অন্য কোন ছাত্রের সিটে কিংবা দারুল ইকামার বাইরে অবস্থান করতে পারবেনা।
৯. তাকরার এবং মুতালার সময় গল্প গুজব করা বা পাঠ্যকিতাব ব্যাতিত অন্য বইপুস্তক পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনটি প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।
১০. অনুমতি ছাড়া এক তলার ছাত্র অন্য তলায় এবং এক রুমের ছাত্র অন্য রুমে যেতে পারবেনা।
১১. রাত দশটা অথবা সাড়ে দশটা থেকে ফজর পর্যন্ত সময় বিশ্রাম ও ঘুমের জন্য নির্ধারিত। এ সময়ে কোন ছাত্র অন্যের বিশ্রাম বা নিদ্রায় ব্যাঘ্যাত সৃষ্টি করতে পারবেনা। কোন ছাত্র যদি এ সময়ে ব্যক্তিগত মুতালা করতে চায় তাহলে সে বারান্দা বা মসজিদে নির্জনে মুতালা করতে পারবে।
১২. প্রত্যেক ছাত্র দারুল ইকামার আসবাবপত্রের সদ্ব্যবহার এবং তা যথাযথ তদারকি ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বশীল হবে। দারুল ইকামার আসবাব পত্র বিনষ্ট হওয়া থেকে সদা সতর্ক থাকবে। প্রতিদিন নিজ কামরা এবং প্রতি সপ্তাহে কামরা ও তার আশপাশ পরিস্কার করার তালিকা করে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করবে। ব্যবহার্য কাপড় ও অন্যান্য আসবাবপত্র গোছগাছ করে রাখতে হবে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখবে।
১৩. দারুল ইকামার জিম্মাদার কর্তৃক প্রত্যেক ছাত্রের সিট নির্ধারিত হবে। সিট পরিবর্তনের এখতিয়ার কোন ছাত্রের থাকবেনা।
১৪. দারুল ইকামায় অবস্থানরত কোন ছাত্র নিজস্ব কোন মেহমানকে মুনতাযিম উস্তাদের অনুমতি ব্যাতিত নিজ বা অন্য কারো সিটে থাকার ব্যবস্থা করতে পারবেনা।
১৫. প্রত্যেকে ছাত্র জামাতের সঙ্গে লালবাগ শাহী মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করবে। আশেপাশের কোন মসজিদে নামাজ আদায়ের অনুমতি থাকবেনা। প্রমাণিত হলে শাস্তিযোগ্য হবে। ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে ঘুম থেকে জাগতে হবে। প্রত্যেক নামাজের দশ মিনিট পূর্বে রুম থেকে বের হয়ে মসজিদে চলে আসতে হবে।
১৬. বাদ ফজর নিয়মিতভাবে কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে এবং তাহাজ্জুদসহ নফল ইবাদাত বন্দেগীর অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
১৭. ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় কোন কাজ থাকলে তা আসরের পর থেকে মাগরীবের দশ মিনিট পূর্বে সেরে মাগরিবের নামাজ লালবাগ শাহী মসজীদে আদায় করতে হবে।
১৮. চরিত্র বিধ্বংসী কোন বই পুস্তক পড়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অবসর সময়ে আকাবের আসলাফদের কিতাবাদি, মাওয়ায়েজ, মালফুজাত এবং ইসলামের বিভিন্ন বিষয়াদির কিতাব মুতালা করবে।
১৯. ক্যামেরা রাখা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোন ছাত্র নিজ বা অন্য কোন ব্যক্তির মোবাইল ফোন নিজের কাছে রেখে ব্যবহার করতে পারবেনা। কারো কাছে এই জিনিষ পাওয়া গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করা হবে।
২০. কোন ছাত্র টিউশনী করতে পারবেনা। বা নিজেও অন্য কোথাও অনুমতি ব্যতিত কোন প্রশিক্ষন কোর্সে অংশগ্রহণ করতে পারবেনা। এমনটি প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
২১. প্রত্যেক ছাত্র দৈনন্দিন চব্বিশ ঘন্টা সময়ের নিজামুল আওকাত বানিয়ে তা নিজ সিটের পেছনে টানিয়ে রাখবে।
২২. ক্লাশের সময় এক দুই ঘন্টা ছুটি নেয়ার প্রয়োজন হলে তা সংশ্লিষ্ট ক্লাসের উস্তাদ থেকে নিতে হবে। নূন্যতম একদিনের ছুটি নিতে হলে তা দারুল ইকামার মুনতাযিমের লিখিত সুপারিশ নিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবের মঞ্জুরী নিতে হবে। অবশ্য ক্লাশের সময় ব্যাতিত স্বল্প সময়ের জন্য কোথাও যেতে হলে দারুল ইকামার সংশ্লিষ্ট মুনতাযিমের অনুমতি নিয়ে যেতে হবে।
২৩. এছাড়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষ অবস্থার প্রেক্ষিতে যে সময় যে নিয়ম জারি করবেন তা প্রত্যেক ছাত্রের জন্য মেনে চলা বাধ্যতামূলক হবে।
আদেশক্রমে জামেয়া কর্তৃপক্ষ
লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপালঃ
হযরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.
১৩৭০-১৩৮৮ হিজরী
৫ই জিলকদ, ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত
মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ মুহাদ্দিস সাহেব হুজুর রহ.
১৩৮৮-১৪০৪ হিজরী
৩০ শে রমজান,এরপর স্বেচ্ছায় অব্যহতি গ্রহণ করেন তিনি।
মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ
১৪০৪-১৪০৭ হিজরী
৮ই রমজান ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত
মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ
১৪০৭-১৪৩৪
মুফতি আমিনী রহ ১৯৪৫-২০১২
মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ ১৯৪৫ সালে ১৫ নভেম্বর বি-বাড়িয়া জেলার আমীনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আলহাজ ও্যায়েজউদ্দিন ছিলেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, আবেদ ও আলেম ওলামা পরশধন্য ব্যক্তিত্ব। মাতা ফুলবানি নেসা ছিলেন একজন পর্দানশীন ধর্মপ্রাণ গৃহিনী।
শিক্ষাজীবনঃ
ফজলুল হক আমিনীর বয়স যখন নয় কিংবা দশ তার বাবা ওয়ায়েজউদ্দিন তাকে দেশের প্রসিদ্ধ দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বি-বাড়িয়া জামিয়া ইউনুসিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষার জন্য ভর্তি করেন। পরবর্তী সময়ে মুন্সিজগঞ্জের মুস্তফাগঞ্জ মাদরাসা থেকে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানে হাফেজ মাওলানা মুহসিনউদ্দিন রহ তাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেন। মুস্তফাগঞ্জে অধ্যায়নের তিন বছর শেষ হলে তার পিতা তাকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকার প্রাচীন দ্বীনী বিদ্যাপীঠ বড় কাটারা মাদরাসায়। সেখানে এসে তৎকালীন প্রিন্সিপাল পীরজী হুজুরের দায়িত্বে বেড়ে ওঠা। অল্পসময়ের ভেতরই মেধাবী আমিনী রহ. নজর কাড়েন হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর। কিছুদিন পর ১৯৬১ সালে হযরত সদর সাহেবের আত্মিক পরশ টানে তিনি চলে আসেন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লালবাগ জামেয়ায়। এখান থেকেই তিনি ১৯৬৮ সালে কৃতিত্বের সালে দাওরায় হাদিস পাশ করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে মুজাহিদে আযম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর নির্দেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাকিস্তানের করাচি বিননুরী টাউন মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে আল্লামা ইউসুফ বিননুরী রহ. এর একান্ত সান্নিধ্যে থেকে হাদীসশাস্ত্র ও ফিকহশাস্ত্রে ডিগ্রি লাভ করে দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবনঃ
১৯৭০ সালে ঢাকার আলুবাজার জামে মসজিদে ইমাম ও খতিব হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তিনি একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময় হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাকে মাদরাসায় নুরিয়াতে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এবং সেই বছরই তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ এর কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে তিনি মাত্র নয় মাসে সম্পূর্ণ কুরআন শরিফ হেফজ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি জামেয়া কুরআনিয়া আরাবিয়ার উস্তাদ ও সহকারি মুফতি নিযুক্ত হয়ে তার উজ্জ্বল ও গৌরবদীপ্ত কর্মজীবনের সূচনা করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রধান মুফতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ১৯৮৭ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ এর ইন্তেকালের পর থেকে তিনি লালবাগ জামেয়ার প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিস হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ২০০৩ সালে জামেয়া হোসাইনিয়া আশরাফুল উলুম বড় কাটারা মাদরাসার মুহতামিম ও মুয়াওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। মৃত্যু অবধি তিনি এই দুই প্রতিষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়াও সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্ধশতাধিক মাদরাসার প্রধান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন মুফতি আমিনী রহ.।
আধ্যাত্মিক জীবনঃ
মুফতি আমিনী রহ. ছিলেন দক্ষ শিক্ষক, প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ ও সফল সংগঠক। সেই সাথে তিনি ছিলেন তাসাউফ ও আধ্যাত্মিক জগতের রাহবার। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করে সব কাজের সমাধানে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তিনি হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর “মাজাযে সোহবত” ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে শায়খুল ইসলাম হযরত হোসাইন আহমদ মাদানী রহ এর অন্যতম খলিফা হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফি দা.বা. ও হাফেজ্জী হুজুরের অন্যতম খলিফা আব্দুল কবির রহ সহ আরো বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট শায়েখ বাইয়াত করার অনুমতি প্রদান করেন।
রাজনৈতিক জীবনঃ
দ্বীন প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক বিভিন্ন ইস্যুতে আপোষহীন সংগ্রামী এই নেতার রাজনীতিতে পদচারণা শুরু হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর হাত ধরে। ১৯৮১ সালে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন গঠিত হয়। এবং মুফতি আমিনী রহ. এ সংগঠনের সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৮১ ও ১৯৮৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের দক্ষিণ হস্ত হয়ে দেশব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর ইন্তেকালের পর ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে লংমার্চ ও ১৯৯৪ সালে নাস্তিক মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অন্যতম বীর সিপাহসালার। উলামা কমিটি, জমিয়তুল আনসার, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ, ইসলামী মোর্চার মত বিভিন্ন কমিটি ও মজবুত সংগঠনগুলো প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তার সাংগঠনিক দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির আমীর, উলামা কমিটি বাংলাদেশের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও খেলাফতে ইসলামীর আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে ৪ দলীর জোট গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি জাতীয় নেতা হিসেবে দেশব্যাপী ব্যাপক সুখ্যাতি ও পরিচিতি লাভ করেন। ২০০১ সালে হই কোর্ট থেকে “সব ধরণের ফতোয়া নিষিদ্ধ” মর্মে কুরআন হাদিস বিরোধী রায় দেয় আদালত। এ রায় শুনে সর্বপ্রথম যিনি হুংকার দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন মুফতি আমিনী রহ.। রায় প্রদানকারী দুই বিচারপতিকে শরিয়তের আলোকে মুরতাদ ঘোষণা করেছিলেন। আন্দোলন তীব্র হয় উঠতে থাকলে তিনি সরকারের রোষানলে পড়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। দীর্ঘ চারমাস কারা নির্যাতন ভোগ করেন। ২০০১ সালে ৮ম জাতীয় নির্বাচনে তিনি চার দলীয় জোটের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিবাড়িয়া ২ নির্বাচনী আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে আওয়ামী সরকার কুরআন সুন্নাহ বিরোধী নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদন ও ইসলাম বিরোধী নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করলে তিনি এর প্রতিবাদে দুর্বার আন্দোলনের ডাক দেন। সেই বছরই ৪ই এপ্রিল তার ডাকে দেশব্যাপী নজিরবিহীন সকাল সন্ধ্যা হরতাল পালিত হয়। আওয়ামী সরকারের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে উনার দুর্বার আন্দোলন সরকারের ক্ষমতা হুমকীর মুখে পড়ে যায়। তাকে আন্দোলন থেকে দমিয়ে রাখতে শেষ পর্যন্ত তার ছোট ছেলে আবুল হাসানাত আমিনীকে গুম করে তাকে ফোনে হুমকি দেয়া হয় যে আন্দোলন থেকে ফিরে না এলে ছেলেকে ফেরত দেয়া হবে না। কিন্তু তিনি এসব কিছুর সামনেই নতি স্বীকার করেননি। আন্দোলনকে আগের চেয়েও দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেছেন।
১৯৮৪ সালে ইরাক ইরান যুদ্ধ বন্ধে তিনি হাফেজ্জী হুজুরের সাথে ইরানের শান্তি মিশনের অনুতম সদস্য ছিলেন। বেশ কয়েকবার হজ-উমরা পালনসহ তিনি লন্ডন, সিরিয়া, ভারত, কুয়েত, কাতার, আবুধাবী ও পাকিস্তান সফর করেন।
দেশব্যাপি তার প্রতি তৌহিদী জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন থাকায় তাকে সরাসরি কারারুদ্ধ করতে না পেরে সবশেষে সরকার এক নতুন ফন্দি আঁটে। নিরাপত্তার নামে তাকে করা হয় গৃহবন্দি। এরপর থেকে মৃত্য পর্যন্ত দীর্ঘ একুশ মাস তিনি গৃহবন্দি ছিলেন। দীর্ঘ একুশ মাস গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় সংগ্রামী এ বীর সেনানী ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ১২ টা ২০ মিনিটে শহিদী মর্যাদায় ভূষিত হয়ে প্রিয় প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান। বাংলার ইতিহাসে নজিরবিহীন এই জানাজায় হরতালের দিন শত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল ও দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকার জাতীয় ঈদগাহ ময়দান ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বিপুল সংখ্যক ভক্তবৃন্দ একত্রিত হয়েছিল। বৃহত্তর এই জানাজায় শরিক হয়ে গৃহবন্দীত্বের শেকলে মুফতি আমিনী রহ. কে বন্দী করে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার এক নিরব এবং জোরদার প্রতিবাদ জানিয়ছিল সেদিন তৌহিদী জনতা। অভিজ্ঞ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ছয় লাখেরও অধিক মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেছিল। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের উচু মাকাম দান করুন। আমীন!